বাংলা ছোট গল্প 

50+ Best Short Stories in Bengali [বাংলা ছোট গল্প]

1.  আমার মা সব জানে  -- পর্ব ১


(সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী )


পিকু সবে পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পড়েছে, শহরের নামী কনভেন্ট স্কুলে ক্লাস ওয়ানে উঠেছে, লেখাপড়া সে ভালোবেসে করে আর খুব সুন্দর পেন্সিল স্কেচ করে এই বয়সেই...... গুণটি তার সহজাত। খেলতেও খুব ভালোবাসে, তবে ছুটোছুটি করে নয়। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে আর প্রতিটি বিষয়েই কোনো না কোনো প্রশ্ন করে আর যতক্ষণ পর্যন্ত না উত্তরটি পিকুর নিজের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার এই প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতেই থাকে।

পিকুর মা ধীময়ী একটি বেসরকারি বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়, পিকুর আর পিকুর মায়ের স্কুলের সময়টা এক হওয়ার ফলে পিকু মায়ের সঙ্গ ভালো মতোই পায়। ধীময়ীর নিজের খুব বই পড়ার নেশা আর মেয়ের মধ্যেও ধীময়ী এই অভ্যাসের বীজ বপন করে দিয়েছে....... সময় পেলেই পিকু দোতলার গ্রীল ঘেরা বারান্দায় একাএকা চুপটি করে বসে গল্পের বই পড়ে। পিকুর বাবা চঞ্চল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পদস্থ কর্মী, সকালে সাড়ে আটটায় বাড়ী থেকে বেরোয় কোম্পানির গাড়িতে, ফেরার সময়ের কোনো ঠিক নেই, বেশীর ভাগ দিনই রাত দশটা পার করে ফেরে।
চঞ্চল নিজের অফিস, নিজের কাজ-মিটিঙ, অফিস ট্যুর এইসব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে পিকু বাবার কাছে বিশেষ ঘেঁষে না। পিকুর সাথে বাবার দেখা হয় ব্রেকফাস্ট টেবিলে আর রবিবার দুপুরে খাওয়ার সময় যদি চঞ্চলের কোনো অফিস ট্যুর না থাকে তবেই।

পিকুর দাদান অবনীশবাবু রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ অফিসার, ওনার শখ.......বাগান করা, বেড়ানো, উচ্চাঙ্গসংগীত শোনা আর মাঝেমধ্যে ছিপ নিয়ে টিকিট কেটে মাছ ধরতে যাওয়া। পুত্রবধূ ধীময়ীকে পছন্দ করেছিলেন ওর গাওয়া অপূর্ব উচ্চাঙ্গসংগীত শুনেই। অবনীশবাবু অত্যন্ত স্বল্পবাক, তাই পিকু কোনো প্রশ্ন নিয়ে দাদানের কাছে গেলে দাদানের ঐ সংক্ষিপ্ত উত্তর পিকুর একদম পছন্দ হয় না।

মলিনা দেবী পিকুর ঠাম্মি, সারাদিন রান্নাঘর আর ঠাকুরঘর নিয়েই ব্যস্ত, কারোর কোনো সাতেপাঁচে থাকেন না। পুত্রবধূ ধীময়ীর সাথে আলোচনা করে তবেই আজকাল খুঁটিনাটি সাংসারিক সিদ্ধান্ত নেন। তবে পিকুকে অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং একমাত্র নাতনির জন্য মাঝেমধ্যেই টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে আনেন বাইরে বেরোলেই। পিকু ঠাম্মির কাছে আচার, চিনির পরোটা, বাদাম পকোড়া, তরমুজের শরবত ইত্যাদি খাবার আবদার করলেও, প্রশ্ন নিয়ে কখনো নয়, কারণ প্রশ্ন করলেই ঠাম্মি বলেন, "আমি কি অতশত জানি সোনা?"

সুতরাং পিকুর সব প্রশ্ন মায়ের কাছেই, আর সব প্রশ্নের উত্তরই ধীময়ীও পিকুর বোঝার মতো করেই দেয়। অনেক বছর আগে একবার ধীময়ী "সানন্দা" ম্যাগাজিনে পড়েছিলো যে বাচ্চাদের মনে অনেক রকম প্রশ্ন জাগে আর সেই প্রশ্নের উত্তর বাচ্চাদের বোঝার মতো করেই দিতে হয়। বড়রা বাচ্চাদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে বাচ্চাদের কৌতূহল আরও উদগ্র হয়ে ওঠে এবং বাচ্চারা যেণ তেণ প্রকারেণ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল কিছু উত্তর পেয়ে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়ে। তাই প্রতি মায়ের কর্তব্য সন্তানের প্রশ্নের যথাযথ বোধগম্য সঠিক উত্তর দিয়ে সন্তানের মনের কৌতূহলের নিরসন করা। বাচ্চাদের মনে এই বিশ্বাস তৈরি হওয়া জরুরী "আমার মা সব জানে" এবং এতে করে সব প্রশ্ন নিয়ে সহজ সরল ভাবে নির্দ্বিধায় মায়ের কাছেই আসবে, এতে করে সন্তানের বিপথে বা নিষিদ্ধ পথে যাবার সম্ভাবনা রোধ হবে। ধীময়ী ওর ক্লাসমেট মনস্তাত্ত্বিক নীপবীথি মিত্রের সাথে আলোচনাও করেছে এই বিষয়ে......... পিকুর সব কৌতূহলের নিরসন করতে সৎভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করে।

পিকু বাবলির সাথে খেলতেও খুব ভালোবাসে, বাবলি পিকুর থেকে বছর দুয়েকের বড়, ক্লাস টুতে পড়ে। বাবলির বাবা ব্যাঙ্কে উঁচু পদে চাকরি করে, বদলির চাকরি, আপাতত এই শহরেই পোস্টিং, তবে আগে বাবলির বাবা অনেকবার অনেক দূর শহরেও বদলি হয়েছে, বৃদ্ধা মা আর পরিবারকে এখানে এই পিকুদের বাড়ীর একতলায় ভাড়া রেখেই। বাবলিরা পিকুদের একতলার ভাড়াটে, যদিও বাবলি অন্য স্কুলে পড়ে তবুও দুজনে একসাথে খেলাধুলা করেই বেড়ে উঠছে।

আজ রবিবার, চঞ্চল বাড়ীতে, দুপুরে সবাই একসাথে খাবার টেবিলে, পিকুকে ধীময়ী ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছে, টুকটাক হালকা কথাবার্তা গল্পগাছা চলছে.............................এমন সময়,
হঠাৎ পিকুর প্রশ্ন, "কাউকে আদর কেন করতে হয়?"
পিকুর মা, "কাউকে ভালোবাসলে আদর করতে হয়," বলে পিকুর চুলগুলো ঘেঁটে দিলো। আবার পিকু, "তাহলে যে যাকে আদর করে সেই তাকে ভালোবাসে?" পিকুর মা, "হ্যাঁরে বাবা।" বড়বড় চোখ মেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পিকুর গলা, "তাহলে বাবা তোমাকে ভালোবাসে না?" পিকুর মা, "বাসে তো!" পিকু আর পিকুর মায়ের আলাপচারিতায় খাবার টেবিলে নিঃস্তব্ধতা....... পিকুর প্রশ্ন, "তাহলে বাবা বাবলিদিদির মাকেও ভালোবাসে? বাবা তো কাল বাবলিদিদির মাকে আদর করছিলো!" সকলের কানে যেন কেউ গলানো গরম লোহা ঢেলে দিলো! কিন্তু পিকুর মা ধীময়ীর শান্ত ধীর স্থির দৃপ্ত নিরুত্তাপ উত্তর, "জানি তো, বাবলিদিদির বাবা একতলার ঠাম্মুকে পিসিমণির বাড়ীতে রাখতে গেছে তো, তাই বাবলিদিদির মায়ের জ্বর মাথাব্যথা এইসবে বাবা একটু আদর করে দিয়েছে, নাহলে তো বাবলিদিদির
মায়ের আরো বেশি শরীর খারাপ হবে, তখন তো বাবলিদিদি কেঁদে ফেলবে একাএকা আর তোমার সাথে খেলতেও পারবে না, তাই তো আমি বাবাকে পাঠালাম ওদের ঘরে, দাদান-ঠাম্মির আমার সবার কাজ ছিলো, তোমার আর বাবলির খেলা ছিলো, শুধু বাবা একাই ফ্রী ছিলো ট্যুর থেকে ফিরে তাই বাবাকে পাঠিয়ে দিলাম বাবলিদিদির মাকে আদর করে দিয়ে আসতে।" খাবার টেবিলের নৈঃশব্দ্য ভেঙে আবার পিকুর গলা, "ভালুকছানাকে বাড়ীতে পোষা যায়?" পিকুর মায়ের উত্তরটা পিকুর বাবার কানে আর কিছু ঢুকছে না, তাড়াতাড়ি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যেন পালিয়ে বাঁচলো।

পিকু নেচে নেচে চেঁচিয়ে চলেছে, "এএএ.... আমার মা সব জানে.......এএএ আমার মা সব জানে........
এএএএএএ.......আমার মা সব জানে......এএএ..."


😰😰😰😰😰😰😰😰😰😰😰😰😰😰

সমাপ্ত

ーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーー


50+ Best Short Stories in Bengali [বাংলা ছোট গল্প]


2. বাচ্চা ভয়াংকর (ছোট গল্প)


বাচ্চাদের দেখলে কার না ভালো লাগে।বাচ্চাদের হাসি যেন পূর্ণ চন্দ্রিমার টিকা।তাদের দুষ্টুমি দেখলে মন হয়ে যায় পাগল পাড়া।তাদের আদো আদো কথা কেড়ে নেয় প্রাণ,ছুয়ে যায় হৃদয়।তাদের সাথে খেলতেও ভালোবাসে অনেকে।কিন্তু কেমন হবে যদি কেউ বাচ্চাদের ভয় পায়?বাচ্চাদের দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে,তাদের কথা শুনলে গলা শুকিয়ে যায়,তাদের দুষ্টুমি দেখলে মাথা ঘুরে যায়,শরীরে আসে ১০৪° জ্বর,তাহলে???????

অজপাড়া গায়ের নিধিরাম ঠিক এমনই এক মানুষ।বাচ্চাদের ভীষণ ভয় পায়।বাচ্চা হয়ে যাবার ভয়ে বিয়ে পর্যন্ত করে নি।কারো বাড়িতে বেড়াতেও যায় না।রাস্তাঘাটে কোনো বাচ্চা দেখলেই ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসে।তার কাছে বাচ্চা মানেই এক মহা ঝামেলা।এক অতীব আধিভৌতিক বিষয়।পাড়ার অনেকেই তাকে নিয়ে ঠাট্টা,তামাশা করেন।নিধিরামের তাতে কিছু যায় আসে না।কারন সে বড়দের মোটেও ভয় পায় না।

একবার তো তার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল।ডাকাতদের নাকি সে একাই ঘায়েল করে একেবারে কাবু করে ফেলেছিল।যে ডাকাতকে সবাই ভয়
পায়,ডাকাতদের ছায়া দেখলেও ভয় লাগে সেই ডাকাতকে একাই যে কাবু করে ফেলতে পারে সেই নিধিরাম  বাচ্চাকে এত ভয় পায় ভাবতেও কেমন হাস্যকর লাগে।তাও এতটাই ভয় যে যমকেও কেউ এত ভয় পায় না।এর কারন আজ অবধি কেউ খুঁজে পায় নি।সেটা শুধু নিধিরামই জানে।

সবসময় সবার একাদশে বৃহস্পতি থাকে না।সবার জীবনেই আসে চরম দুর্দিন।নিধিরামের জীবনেও তা কাল হয়ে দেখা দেয় বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে।

এক সকালে নিধিরাম বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল।হঠাৎ করে দরজায় ঠুকা পড়লো।উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলে সে।দরজা খুলে যাকে দেখল তাকে দেখে নিধিরামের মন খুশিতে নাচতে লাগলো।সেই কবে তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল তাও বোনের কাকুতি মিনতিতে।আর আজ সেই বোনই নিজে এসেছে তার ভাইয়ের বাসায়।খুশি তো আর ধরে না।

বোনকে এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখায় ভীষণ লজ্জিত অনুভব করল নিধিরাম।আয় লক্ষী দি ভিতরে আয়,,,,,,নিধিরাম  বলল।তার বোনের নাম লক্ষী।মায়ের দেওয়া নাম।লক্ষী বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,কই গো আসো।এবার নিধিরামের মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো।গায়ে যেন ১৬০ ভোল্টেজ এর কারেন্ট লাগছে।এতক্ষণ যে মুখের ৩২ টা দাঁত দেখা যাচ্ছিল সেই মুখই নিমেষের মাথায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।বাইরে দাঁড়িয়ে আছে জামাইবাবু।সেটাও কোনো সমস্যা নয়।জামাইবাবুর কোলে যে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা।মাথায় ইয়া বড় কালো টিপ,পরনে গেঞ্জি ও থ্রি কোয়াটার জিন্স।বাচ্চাটা যেন তার দিকেই পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।এবার কি করবে নিধিরাম।উনার বাড়িতেই সাক্ষাৎ যম এসে উপস্থিত।মুখের ভাষা চলে গেছে,কথা বন্ধ হয়ে গেছে।শুধু শিকারী বাঘের আয়ত্বে থাকা শিকারের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিধিরাম।

নিধিরামকে এমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লক্ষী বলে উঠলো,কি রে ভাই আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি এভাবে?নিধিরাম কোনো কথা বললো না,নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।ভাইয়ের এমন আচরণ মেনে নিতে পারলো না লক্ষী।স্বামীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেই রান্নাঘরে চলে গেল।ভালো করে রান্নাবান্না করলো।তারপর স্বামীকে নিয়ে খেয়ে নিল।ততক্ষণ নিধিরামও ঘর থেকে বের হলো না আর কেউ ডাকলোও না।

এদিকে নিধিরামের ভীষণ বাথরুম পেল।আবার বাথরুমে যেতে হলে তো রূম থেকে বের হতেই হবে।বাচ্চাটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?না কি জেগে আছে?নিধিরাম ভয়ে ভয়ে বাইরে বের হয়ে বাথরুমের দিকে যেতে লাগলো।হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ালো লক্ষী।কোলে তার বাচ্চা ছেলেও রয়েছে।নিধিরামকে দেখতে পেয়েই একমাত্র মামার কোলে ছেলেকে জোর করে ধরিয়ে দিল লক্ষী।নিধিরাম ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
একটা জ্বলজ্যান্ত বাচ্চা তার কোলে এটা যেন মেনে নিতে পারছে না।তার যে বাথরূম পেয়েছে সেটা সে ভুলেই গেল।

তবে নিধিরামের ভয়টা দুইদিনেই কেটে যায়।তার মধ্যে ভয় ছিল কারন এক বাচ্চা ছেলে একদিন তার উপর ঢিল ছুড়ে মেরেছিল।সেই ঢিলের প্রতিঘাত সে কিছুতেই করতে পারে নি।তাই তার মনে বাচ্চাদের নিয়ে ভয় ঢুকে যায়।কিন্তু তার বোনের ছেলে বান্টির সাথে সময় কাটিয়ে সে বুঝতে পারে বাচ্চাদের মন আসলে খুব নরম হয়।বাচ্চাদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।এরপর থেকে নিধিরাম আর বাচ্চাদের ভয় পায় না।আসলে ভয় কাটাতে হলে ভয়ের মুখোমুখি হতে হয়।ভয় থেকে পালাতে গেলে ভয় আরো ঝেকে বসে।

সমাপ্ত
ーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーーー



3. গুপ্তধন (ছোট গল্প)


ওদিকে যথারীতি সুমেরু অঞ্চলে জীববৈচিত্র বোঝানো হচ্ছে আর আমি যথারীতি ক্লাসের লাষ্ট বেঞ্চে বসে ভুগোল বই এর ভাঁজে আফ্রিকার জংগলে পড়ে আছি। আরে না, আমি অতটাও ভাল ছেলে নই, হেমেন্দ্র কুমারের "আবার যখের ধন" বই এর প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি, টানটান উত্তেজনা, আর ঠিক সেই মুহুর্তে স্যার আমায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাস করলেন যে সুমেরু তে কোন স্থলজ জীব সব থেকে বেশী পাওয়া যায়? আমার গল্পের রেশ তখনো মাথা থেকে যায়নি, আমি উত্তর দিলাম "স্যার, ঘটোৎকচ"। ব্যাস, সেই কেলেঙ্কারি শুরু। ক্লাসে বসে গল্পের বই পড়ার জন্য প্রথম দফায় উত্তম মধ্যম শেষ হলে গার্জেন কল হল। আমি দ্বিতীয় দফায় পিঠের চামড়া ট্যান করার জন্য প্রস্তুত হয়ে বাকি ক্লাস গুলোতে সেই বিষয়ের ক্লাসের বইয়ের ভাঁজে রেখে "আবার যখের ধন" শেষ করে ফেললাম।

আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার গুপ্তধন এর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ আছে। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে সেই বই টাই ইস্যু করতাম, যাতে গুপ্তধন এর গল্প আছে।

এইভাবে মানে গুপ্তধন এর গল্প পড়তে পড়তে মনে হল যে আমাদের ঠাকুর ঘরের বেদীর নিচে একটা সুড়ঙ্গ থাকতে পারে, একদিন দুপুরে কৃষ্ণগোপাল এর মূর্তি টা যেই সরিয়েছি, অমনি পিছনে দেখি ঠাকুমা এসে দাঁড়িয়েছেন এবং চিৎকার করছেন "আমার সব ধর্ম জাত চলে গেল রে, এবার আমার নরকেও যায়গা হবে না রে..."। চিৎকার শুনে মা এলেন, এবং কটুবাক্য প্রয়োগে আমার পিঠের চামড়া...

অনেক হয়েছে আর না, কলেজে উঠে আমি ফাইনাল করলাম যে আর গুপ্তধন খোঁজার দরকার নেই। আমিই গুপ্তধন তৈরী করব, মানে আমিই গুপ্তধন এর সৃষ্টিকর্তা হব। তারপর, কেউ একদিন সেটা আবিষ্কার করবে আর আমার বিরাট নাম হবে। আমার পাগলামি টা পাড়ার সবাই জানে। সুতরাং আমি যে একটা গুপ্তধন রেখে গেলেও যেতে পারি, অন্তত ১০০ বছর পর কেউ না কেউ সেটা সন্দেহ করবে, এটা আমি নিশ্চিত। আমি স্কুল লাইফে ফেলুদার রয়েল বেংগল রহস্য ষ্টাইলে একটা ছড়া লিখেছিলাম, মানে ওই "মুড়ো হয় বুড়ো গাছ, হাত গোন ভাত পাঁচ...", এর ছন্দ অনুসারে। এই ছড়া টা লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সংকেত হিসাবে। তো আমি ভাবলাম দেশের যা শিক্ষা ব্যাবস্থা, শ খানেক বছর পর বাংলা ছড়া কেউ আর পড়বে না। তার থেকে একটা ম্যাপ আঁকা যেতে পারে। তবে ম্যাপের কাগজ নষ্ট হলে অনেক বছর পর আমার গুপ্তধন কেউ পাবে না। সুতরাং ম্যাপ টাও ঠিক ফুলপ্রুফ নয়।

আমার মাথায় সারাদিন চিন্তা ঘোরে, আমার তৈরি গুপ্তধন গুপ্ত রাখব, আবার সেটা আবিস্কার করাটাও যেন কঠিন না হয়। ইতিমধ্যে চাকরি পেলাম। চাকরির প্রথম মাইনে পেয়েই গুপ্তধন রাখার ঘড়া কিনতে গেলাম। বাবাহ, পিতলের যা দাম! শেষে কয়েকটা এলুমিনিয়াম এর কিছু কলসি যোগাড় করলাম। আগেকার দিনে গুপ্তধন হিসাবে রূপোর ঘড়ায় সোনার মোহর থাকত, এখন তো স্বর্ণমুদ্রার যুগ নেই, তাই এলুমিনিয়াম এর কলসিতেই মাইনের অনেকটা অংশ দিয়ে প্রতিমাসে দশ টাকায় কয়েন যতটা পারি যোগাড় করে কলসি ভর্তি করার চেষ্টা করছি। আমি এটিএম থেকে মাইনের টাকা পুরোটা তুলি না। কিছুটা টাকা ব্যাংকে গিয়ে দশ টাকার কয়েনে তুলি। দশটাকার স্বর্ণমুদ্রা সদৃশ্য দশ টাকার কয়েনে আপাতত আমার খাটের তলায় কয়েকটা কলসি ভর্তি ও হয়ে গেছে। আমার পরিকল্পনা হল আরো কয়েকটা কলসি ভরে কোন গোপন স্থানে খুব ইনোভেটিভ সাইড করতে হবে। প্রত্যেক কলসীতে কাগজে ল্যামিনেশন করে আমার পরিচয়ের ট্যাগ লাগিয়ে দেব। ব্যাস, শ খানের বছর পর আমি বিখ্যাত হব। আমার পাড়ায় আমার পরবর্তী প্রজন্ম আমায় নতুন ভাবে চিনবে। তখন হয়ত আমি বেঁচে থাকব না, কিন্তু আমার উত্তর পুরুষেরা আমার নাম গর্বভরে উচ্চারণ করবে।

ঠিক এমন সময় একদিন রাতে ঘোষনা হল "মিঁত্রো...", "মেরে পেয়ারে দেশবাসীও..." মানে পাঁচশো, হাজার এর নোট বাতিল। শোনা গেল ব্যাংক 
আর এটিএম থেকে এখন কিছুদিন দিনে দুই হাজার টাকা করে পাওয়া যাবে। আমাদের পাড়ায় সবার সবার হাতে হাতে কিছুদিনেই দুই হাজারের নোট চলে এল খুচরো নেই। কিন্তু গোলাপি নোট নিয়ে বাজারে আলু পটল কিভাবে কিনবে পাড়ার লোক? আমার বাবা আবার একটু পাড়ায় মুরুব্বি গোছের লোক। গতকালের বিকালের আড্ডায় বললেন যে চাপ কি? আমার ছেলে তো দেখি গোছা গোছা দশটাকার কয়েন বাজারের ব্যাগে নিয়ে আসে, কই সেসব তো খরচা করতে দেখিনি...।

আজ সকালে দেখি আমার বাড়ীর সামনে লম্বা লাইন, মায়ের কাছে শুনলাম কাল রাতে সব ঘড়া বাবা বাজেয়াপ্ত করেছেন, পাড়ার স্বার্থে। আমার বাবা কাল অনেক রাত জেগে দুশো টা কয়েনের এক একটা করে প্যাকেট বানিয়ে রেখেছিলেন। এখন সেই প্যাকেট বিলি হচ্ছে এক একটা গোলাপি নোটের বদলে।

কি ভাবছেন? কান্না আমার গলায় দলা পাকাচ্ছে? আমি হতাশ? আরে না না, পাড়ার লোকের কাছে আমি তো এখন রীতিমত সেলিব্রিটি। কয়েকটা বন্ধু তো দু হাজার ভাংগিয়ে আমায় বলল, রাতে খাওয়া আছে, ক্লাবে আসিস, আর তোকে যাতে পাড়াতে একটা সম্বর্ধনা দেওয়া হয় সেটা নিয়ে সেক্রেটারি কে আজ প্রস্তাব দেওয়া হবে।

নাহ: ভেবে দেখলাম এতদিনে গুপ্তধন কনসেপ্ট এ বরাবর মৃত ব্যাক্তিরাই বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় আমারি গুপ্তধন আমায় এভাবে বিখ্যাত করবে তা ভাবি নি। 

সমাপ্ত
ーーーーーーーーーーーーーーーーー





Previous Post Next Post