বাংলা ছোট গল্প তালপাতার সেপাই

তালপাতার সেপাই

প্রদীপ ভট্টাচার্য


লত পত। লত পত। লেফট-রাইট। রাইট-লেফট । কাঠিটা এদিক ওদিক নাড়ালেই সেপাইয়ের হাত-পা উঠে নামছে। রাম বিজয়ার মেলা থেকে মার সঙ্গে গিয়ে কিনে এনেছে বুগান। এক জোড়া তালপাতার সেপাই। আরও কত কী ছিল। ভেঁপু, ঢােলক, বড়াে বড়াে বেলুন। সেপাইটাই বেশি পছন্দ হল বুগানের। দিদি কিনেছে ইমিটেশানের হার আর হেয়ার ব্যান্ড। বঁটিতে ধার নেই বলে কুটনাে কাটার সময় ঠাম্মা রােজ গজ গজ করে। মা একটা বাটি কিনেছে। আজ আর পড়াশােনার বালাই নেই। খাটে শুয়ে পা দুটো দেয়ালের উপর তুলে দু-হাতে দুটো সেপাই নাচাচ্ছে বুগান। দিদি পাশে বসে অঙ্ক করছে। দিদির এবার মাধ্যমিক। বুগানের ক্লাস ফাইভ। বাংলা মিডিয়াম। ওদের ভাড়া বাড়ি টালির চাল। দুটো ঘুপচি ঘর। আধখানা কিচেন। কমন বাথরুম। আজ রাম বিজয়া তায় রােববার। তবু বাবার ছুটি নেই। বাবা কনস্টেবল। হাবিলদার। পাড়ার চায়ের দোকানে যারা আন্ডা মারে, ওই পুকদা, ভন্টাদা, ওরা বুগানকে হাবিলদারের ব্যাটা বলে খ্যাপায়। পাশের বাড়ির খগেন জেঠ কথায় কথায় বাবাকে বলে মাইনে যতই হােক তােমরা হলে গিয়ে সরকারের সেপাই। খেলতে খেলতে চোখ লেগে আসে। মেলায় অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। সেপাই দুটো বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়ে বুগান। ঘণ্টা খানেক পরে দিদির ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। দিদি চাপা গলায় বলে চুপচাপ খেতে যা। বাবা ফিরেছে খুব রেগে আছে।

বাবা সত্যিই খুব রেগে আছে। বাবা যখন রাগে তখন মুখটা থম থম করে। চোখের কোণ দুটো লাল হয়ে যায়। আজ গােটা চোখটাই যেন লালচে। মুখে একটাও কথা নেই। প্লাস্টিকের একটা ডাইনিং টেবিল আছে। তিনটে চেয়ার ঢোকে। তারই দুটোয় দিদি আর বুগান বসে খাচ্ছে। অন্যটায় বাবা। ঠাম্মার আগে খাওয়া হয়ে যায়। মা সবার শেষে। বাবা আজ রুটিগুলাে জোরে জোরে ছিড়ছে। কোনােরকমে দুটো খেয়ে উঠে গেল। মা কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর সাহস পেল না। ভাই বােন টু শব্দটি না করে মাথা নীচু করে খাচ্ছে। মাথার উপর ফ্যানটার ঘটঘটা শব্দ। পাশের বাড়ি থেকে মেগা সিরিয়ালের ডায়ালগ ভেসে আসছে। বাবা মুখ ধুয়ে এসে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। আড়চোখে বাবার। দিকে তাকায় বুগান। বাবার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে লাইট পােস্টের আলাে এসে মুখের ওই পাশটায় পড়েছে। খাটের উপর তাল পাতার সেপাই দুটো পড়ে। বুগানের দেখানাের খুব ইচ্ছে ছিল। আজ আর দেখানাে যাবে না। সিগারেটটা শেষ করে খাটে বসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে যায় বাবা। তালপাতার সেপাই দুটো দেখে। থমথমে মুখে ফ্যাকাশে হাসি ফুটে ওঠে। কাঠিটা ধরে নাড়াতেই লতপতিয়ে হাত পা নাড়ে সেপাই। বাবা এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেপাইটার দিকে। থালা থেকে। তুলে মিন মিন করে বুগান, মেলা থেকে এনেছি' বাবা কাঠি ধরে তালপাতার সেপাইটার হাত-পা নাড়িয়ে বলে একেবারে তাের বাবার মতাে।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল বুগানের। মায়ের গলা কাউন্সিলারের বখাটে ছেলেটা তােমাকে মারল? বড়াে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওপেনলি মদ খাচ্ছিল। আমি শুধু বারণ করেছি। নােংরা খিস্তি করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরা তিন চার জন ছিল। আশপাশের দোকানদাররা এসে না ছাড়ালে, মা বাবার গলা ভাঙাভাঙা লাগছে। চোখের পাতা অল্প খুলতেই বুগান দেখল, মশারির মধ্যেই এক কোণে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে বাবা। মা পাশে বসে বাবার পিঠে হাত বােলাচ্ছে। আধ খােলা চোখের পাতা বুজে ফেলে বুগান। মা বলে পুলিশের গায়ে হাত দিয়েছে! এত বড়াে সাহস! থানায় গিয়ে অফিসারদের বললে না?
–মেজবাবু শুনে খুব রেগে গেছিল। আমাকে বড়াে সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। বড়ােসাহেব সব শুনে কাঁধে হাত দিয়ে বলল, চেপে যান। সেম ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটলে আমিও তাই করতাম। আমরা সব তালপাতার সেপাই। ভুলে যান। আরও অনেক কথা বলছিল বাবা। শােনার মতাে অবস্থা ছিল না বুগানের। তার আগেই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল।

ভাের রাতে বৃষ্টি এল। গুটি গুটি পায়ে স্বপ্ন এসে উঁকি দিল বুগানের ঘুমের জানালায়। সার বেঁধে একদল লােক এগিয়ে আসছে। তালে তালে ওদের হাত-পা মাথা উঠছে। আর নামছে। দলটা আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এল। আরে সব কটা তালপাতার সেপাই। মুখগুলাে কিন্তু মানুষের। ওই তাে লাইনের পিছন দিকে বাবাদের থানার বড়ােবাবু। তারপর মেজবাবু। আর তিন জনের পর ওটা কে? বাবা না? হ্যা বাবাই তাে। সবাই তালে তালে হাত পা নাড়ছে। লেফট-রাইট। রাইট-লেফট। লত পত। লত পতু। 

———————————————————
Previous Post Next Post