Story in Bangla (বাংলা ছোট গল্প)
বাংলা ছোট গল্প
ইলিশগন্ধ
(অনিল ঘড়াই)
ট্রেন থেকে নেমে ক্ষিতীশ ভাবল - এবার কোন দিকে যাওয়া যায়। রেললাইন, খােয়া পাথর পেরিয়ে সে ধীর পা়ে। ছাতিম গাছের ডালে বসে ঘুঘু ডাকছিল সুর তুলে। অন্য দিন হলে ক্ষিতীশ খােয়া ছুঁড়ে মারত। ঘুঘুটাকে না ভাগানাে রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ভীতু চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। খটখটে দুপুরের রােদ চারদিকে ছেয়ে আছে এখন। কিনছু সু্। ভাগানাে পর্যন্ত সে। শান্তি পেত না। আজ আর সে পথে গেল না ক্ষিতীশ। হাতের ব্যাগটা নিয়ে সে স্টেশনের শেষ প্রান্তে চলে এল। স্টেশনের নাম লেখা সিমেন্টের বাের্ডের কাছে দभাড়িয়ে ক্ষিতীশ ভাবছিল - এবার সে কোনদিকে যাবে। যে দিকেই না কেন চেনাজানা কারাে-না-কারাের সঙ্গে তার ঠিক দেখা হয়ে যাবে। সন্ধ্যাতারা গ্রামের লােকজন হাটবাজার করতে প্রায় স রেল বাজারে আসে। সকালবেলায় স্টেশনের সামনের মাঠে তরিতরকারির বাজার বসে। আশেপাশের গ্রামগুলাে থেকে চাকি আসে বেচাকেনা করতে। এখন হাটের বাঁধন হালকা এই রক্ষে। বেলা এগারােটার পরে ফাকা হয়ে যায় হাট। | চটপট রেলিং টপকে বাইরের পিচ রাস্তায় গিয়ে দাড়াল। এ সময় খিদে ভাবট বড়াে চাউড় দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। রাধারানি হােটেলটা রেলবাজারের নামকরা হােটেল। দুপরে ভালাে ভিড় হয়, সন্ধেতেও কম যায় না। কতদনের চেনাজানা হােটেল, তবুও ওখানে যেতে সাহস হয় না ক্ষিতীশের। রাধারানির যৌবন ঢলেছে, কিন্তু তার স্বামী-খেদানাে মেয়েটার রূপ-যৌবন ছলাৎ নদীর জলের মতাে। ওর নাম কামিনী। গায়ের রং স্বর্ণচাপ ফুলের মতাে। কথায় সুগন্ধ ছােটে চতুর্দিকে। ওখানে গেলে যত্ন করে খাওয়াবে কামিনী। দামও কম নেবে। চাকুরিয়া বলে রাধারানি তােয়াজ করে কথা বলে ওর সঙ্গে। মন চাইলেও ক্ষিতীশ ওখানে যেতে পারে না। ওখানে বাবু-ভদ্রলােকের ভিড় লেগেই থাকে। কিছু দুরে থানা। পুলিশেরাও 'মিল খেতে আসে। ওখানে যাওয়া মানে গনগনে আগুনে পা দেওয়া। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনা। কবজি উলটে ক্ষিতীশ ঘড়ি দেখল। পাক্কা একটা। এখন চেনাজানা কেউ আর রেলবাজারে থাকবে না। ব্যাগটা নিয়ে ক্ষিী
দু-দিন ধরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছিল শহরে। নদীতে ইলিশ মাছের ঝাক এসেছে এমন খবরও শুনেছিল ক্ষিতীশ। বাসস্ট্যান্ডের হাসি পান খেতে এসে বলেছিল, ক্ষিতীশদা, ভুলে গেলে যে। কত দিন হল এদিকে আর আসনি। কী ব্যাপার, অন্য ঘাটে নৌকো বাঁধলে বুঝি?
- না, না। তা নিয়ে। ক্ষিতীশ হেসেছিল, সময় পাইনে। কাজের বড়াে ঝামেলা। সরকারি কাজ। বােঝ তাে। এসব অজুহাত। ক্ষিতীশও জানে, হাসিও জানে। দশঘাটে জল খাওয়া যার স্বভাব তাকে এক ঘাটে বেঁধে রাখা যাবে না। ক্ষিতীশ বুঝিয়েছিল হাসিকে, তােমার খরচাপাতি যা লাগে সব দেব। তবে একটা শর্ত। তুমি আর অন্য কোনাে পুরুষের চোখে চোখ রাখবে না। বাঁচব। জান দিয়ে তােমার সেবাযত্ন করব। হাসির কথায় রক্তহীন চোখে তাকিয়েছিল ক্ষিতীশ। বউয়ের মর্যাদা চাইছে হাসি। তা কী করে সম্ভব! ঘেমে নেয়ে ক্ষিতীশ। বলেছিল, সে পরে দেখা যাবে। এখন কাজের কথা শােনাে। কেষ্ট মাঝি বলছিল, নদীতে ইলিশের ঝাক এসেছে। জালে ধরা পড়েছে। তুমি বললে কেজি মাপের ইলিশ কিনে দিয়ে যেতে পারি।। ঠিক আছে, তাই হবে। স্ট্যান্ড থেকে তুমি আমাকে তােমার ঝুপড়িতে নিয়ে চলাে। ওখানে ডালভাত যা পাই তাই খেয়ে
- তুমি খেতে আসবে?
- দিনে হবে না, রাতে আসব। ঘাড় নেড়ে পানখিলির দাম মিটিয়ে দিয়েছিল ক্ষিতীশ। এত বড়াে, এত সুন্দর ইলিশ কেষ্ট মাঝির জালে আগে ধরা পড়েনি। হয়তাে ক্ষিতীশের মনের বাসনা পূর্ণ করেছেন। নদীমাতা। নদীর ধার থেকে মাছের দাম মিটিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসেছিল ক্ষিতীশ। ইলিশ মাছটা হাসির হাতে দিয়ে বলেছিল, 'ভালাে রে সর্যে দিয়ে রেঁধাে। আমি ঠিক সময়ে আসব। তবে বলে রাখি, আজ আর আমি ঝুপড়িতে ফিরব না। রাতটা তােমার এখানেই কাটাব।
হাসি হেসেছিল। ক্ষিতীশ ফিরে এসেছিল কাজে। কাজে মন বসেনি তার। ইলিশ গন্ধে ম-ম করছিল বাতাস। হাসির নারীর ভউয়ে যাচ্ছিল সেই সুগন্ধ। ঘরে স্ত্রী আছে, তবু আর কেন এমন হয়। এমন নয়তো তার গায়ের রং কচি কলাপাতার। কাজল-লেপা চোখ দুটোয় স্বগ্ন উড়ে বেড়ায়। মিঠে নদীর ইলিশের মতাে তার লাজুক স্বভাব। মােহনায় এসেও সে ভাবে ডিম ছাড়া উচিত হবে কিনা। হাসি নােনা জলের ইলিশ। সে সাঁতারে পট। ইলিশমারির জালে একবার আটকে গেলে নিজেকে সমর্পণ করে দেয় পুরাে भांाায়। তার কোনাে বাছবিচার নেই। সে সর্বত্রগামী। বহু ঘাটের জল খেয়ে তার চেকনাই বেড়েছে সাতগুণ। সন্ধ্যের পরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল ঝমকমিয়ে। হালকা নেশা করে ঘমিয়ে গিয়েছিল ক্ষিতীশ। ঘুম যখন ভাঙল তখন বৃষ্টি কমে গেছে। ঘড়িতে দশটা বেজে পাঁচ। এত রাত্রে হাসি কি ভাত নিয়ে বসে থাকবে তার জন্য। একবার ফোন করতে পারত মেয়েটা। ফোনও করেনি। মােবাইল বের করে 'মিস কল আছে কিনা দেখল সে। পারুল হলে নিশ্চয়ই তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলত। এখানেই বউ আর বাইরের মেয়ের মধ্যে পার্থক্য। দুজনেই প্রথমে ইলিশ মাছ থাকে, পরে একজন পুটি মাছ হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠে খিদেটা জব্বর লেগেছিল ক্ষিতীশের। দিনের কাজের কি শেষ আছে তার। সারাদিন কত ধান্দায় খুরতে হয়। সুদে কিছু টাকা বাজারে ছাড়া আছে। সে টাকা আদায় করতে দম বেরিয়ে যাওয়ার দশা। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ নিতে হয়। শুভারব্রিজ পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড পৌছতে কম করে আরও আধঘণ্টা সময় লেগে যায়। একটু রাত বেশি হলে কম হায়ে যায়। कাইনের বাস। লােকজন নজরে পড়ে কম। লাইট পােস্টের আলাে ঘিরে উড়তে থাকে পােকা। ওরা সারারাত উড়তে পারে না। মাঝরাতের দিকে নেতিয়ে পড়ে থাকে লাইট পােস্টের গােড়ায়। রাস্তার কুকুরগুলাে যত্রতত্র ঘুরছিল। রাতভর ওরা চেল্লামেল্ি করবে। এছাড়া ওদের আর কাজ কী আছে। মনে মনে হেসে উঠেছিল ক্ষিতীশ। নিজেকে মনে হয়েছিল সেও এক কুকুর। না হলে অত রাতে কেউ কারো ঘরে যায়। | মেদিনীপুরের কোন এক অখ্যাত গ্রামে হাসিদের বাড়ি ছিল। বাবা-মা বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর সে অনাথ। দুরসম্পর্কের এক মামা তাকে নিয়ে যায় বাড়ির কাজে লাগাবে বলে। মামা-মামি কারােরই দুর্বলতা ছিল না তার উপর। মাত্র সতেরাে বছর বয়সে হাসির বিয়ে হয়ে গেল শহরের এক ছেলের সঙ্গে। পাঁচ বছর সেই ধূপবাতিওয়ালার সঙ্গে ঘর করেছিল। হাসি। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। তার আগেই ধূপবাতিওয়ালা নেশা করে লােকাল ট্রেনের চাকায় দু-টুকরাে হয়ে গেল। পারুল দেখতে কুৎসিত। পারুল হাসির চেয়ও বেগবতী। সে খামারের ধানগােলার মতাে। সেই থেকে বস্তি ছেড়ে বাসস্ট্যান্ডে উঠেছে হাসি। ঠোট ভরে হাসলেও মাঝেমধ্যে মনের দুঃখটা বেরিয়ে পড়ে। তখন কিতীশের মতাে কেউ এটা-সেটা কিংবা ইলিশি মাছ কিনে ঘরে ঢােকে। সারারাত ফুর্তি করে দাম মিটিয়ে চলে যায়। লাটিম রিকশা চালালেও ওর মনে ভালোবাসা ছাতু ফুটেছে। হাসি মনে ধরেছে লাটিমকে। ভালাে-মন্দ কিছু খেলে লাটিম হাসির জন্য তা আনবেই। জন্মাষ্টমীর দিন টিফিন কৌটোয় তালের বড়া ভেজে হাসিকে দিয়ে গেল। রিকশা নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, মা ভেজে দিয়েছে। খেয়ে জানিও কেমন হয়েছে। এসব কথা বুকের ভেতর থেকে বলে লাটিম। হাসির সারা শরীর কাটা দিয়ে। ওঠে। এত ভালােবাসার কথা সে আর শুনতে চায় না। বাপ-মা নাম রেখেছে ‘হাসি’, অথচ তার জীবনটাই দুঃখে ভরা। লাটিম তাকে ভরসা দিয়ে বলেছে, তুমি চিন্তা করাে না। আমি তােমার সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেব। __ রােজ কামাইয়ের কিছু টাকা হাসির কাছে জমা রেখে যায় লাটিম। তার ইচ্ছে, সঞ্চিত এই অর্থ দিয়ে সে ঘর বসাবে। মাকে বস্তি থেকে নিয়ে আসবে ভাড়ার ঘরে। লাটিমের স্বপ্ন কী করে যেন হাসির চোখে জড়িয়ে যায়। সুখের কথা চিন্তা করে মনে মনে ভয় পায় সে। আজ যখন সর্ষেবাটা দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধছিল সে, তখনই লাটিম এসে টিনের দরজায় টোকা মারে।। টোকা মারার শব্দটা হাসি চেনে। দরজা খুলে দিলে ইলিশ মাছের সুগন্ধটা কা করে নাকে লাগে লাটিমের। জিভে জল আসে।কামাইয়ের কিছু টাকা হাসির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এত সােন্দর বাস ছাড়চে -না খেয়ে যেতে মন করছে না। হাসি বলে, ভালাে তাে, ঘরে এসাে। খেয়ে যাও। কার ভাগেরটা কে পাত পেড়ে খায় ওপরওয়ালাই জানে। হাসি ভেবেছিল। = এত রাতে ক্ষিতীশ আর আসবে না। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। ক্ষিতীশ এল। এসেই মাথায় রক্ত উঠিয়ে বলল, আমারটা তুমি ওকে দিয়ে দিলে? কেন দিলে? তােমাকে মানা করেছিলাম। হাসির মুখে কোনাে উত্তর নেই। ভয়ে ঘামছিল সে। লাটিম পাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হাসি কোনাে ভুল করেনি। ও যা করেছে, ঠিক করেছে।
- ঠিক করেছে - তার মানে?
- মানেটা খুব সােজা। লাটিম সহানুভূতির দৃষ্টি মেলে হাসির দিকে তাকাল, হাসিকে যদি তুমি ভালােবাস তাহলে করে নাও | এর একটা খুটি দরকার। জলে ভাসা কচুরিপানা মতাে ও এদিক-ওদিক ভেসে বেড়াতে পারবে না। ক্ষিতীশ ঢোক গিলে হেরে চোখে লাটিমের দিকে তাকায়, যাওয়া-আসা করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তাে কং আমি ওর খায়-খরচা সব দিই। বিশ্বেস না হয় জিজেস কর ওকে। অপ্রস্ত হাসি এগিয়ে এল ওদের দু-জনের মাঝখানে। লাটিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চুপ করবে? আমাদের জানাশে অনেকদিনের। তুমি এর মাঝখানে এসাে না। দুয়ে-দুয়ে চার হওয়ার মতাে আমাদের এই সম্পর্ক নয়। হাসির প্রশ্রয়ে ক্ষিতীশ আরও গলা চড়াল, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সে ঘর থেকে বের করে দিতে চাইল লাটিমকে। লাটিমের বিক চালানাে শরীর রুখে দাঁড়াল, ক্ষিতীশকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিল সে। কালা ভাঙা টিপির কাছে হুমড়ে পড়ল ক্ষিতীশ। লোহ হাতুড়িটা তুলে নিয়ে সজোরে সে ছুঁড়ে মারল লাটিমের মাথা তাক করে। লাটিম লুটিয়ে পড়ে পিচ রান্তায়। রক্তে ভেসে বাে তার মুখমণ্ডল। হাতের টিল বেরিয়ে গেলে আর ফেরানাে যায় না তাকে। হাসি হতভম্বের মতাে দাঁড়িয়ে আছে টিনের দরজা ধরে কী যে সে করবে বুঝতে পারছে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে স্বপ্নেও সে ভাবেনি। ক্ষিতীশের সঙ্গে লাটিমের বয়সের তফাত অনেক। তবু ক্ষিতীশ যে অমনভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। তাহলে কি সব মানুষ মনের ভেতর এত পশুকে পুষে রাখে। সময় এবং সুযােগমতাে সেই পশুটা বাইরে বেরিয়ে আসে। ফাকা বাসস্ট্যান্ডে একদল কুকুর ডাকতে ডাকতে ছুটে গেল ড্রেনের কাছে। সেই বীভৎস ডাক শুনে হাসির বুকটা কেউ যেন ধারাল নখ দিয়ে খামছে ধরল। ক্ষিতীশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে একপলক হাসির দিকে তাকাল। ডয়ে চোখ কুঁকড়ে গেল তার। আবছা আলাে-অন্ধকারে হাঁপিয়ে-ওয় ক্ষিতীশকে সত্যিকারের জানােয়ারের মতাে দেখাচ্ছিল। রাগে-ঘেন্নায় হাসি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুমি ওকে মেরে ফেললে?
জলজ্যান্ত মানুষটাকে মেরে ফেললে? ওর মার কাছে আমি কী জবাব দেব? স্ট্যান্ডের লােককেই-বা আমি কী জবাব দেব?
-তুমি দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড়াে। যেন কিছু জান না এমন ভান করে শুয়ে পড়াে। আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভাগ্যে থাকলে তােমার সঙ্গে দেখা হবে। ক্ষিতীশ উদ্ভ্রান্ত গলায় কথাগুলাে বলে আর দাঁড়াল না। সন্ধ্যাতারা গ্রামের কথা তার মনে পড়ল। মনে পড়ল পারুলের কথা। হাসিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখটা পিন ফোটাতে লাগল মনের ভিতর। পাপ বাগকে ছাড়ে না। লাটিমের মৃত্যুর জন্য ক্ষিতীশই দায়ী হবে। শহরের রাগী দারােগাবাবু তাকে ছেড়ে দেবে না। হাসির জবানবন্দিতে সব তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালাে রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়া। ঝুপড়িতে ফিরে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নেয় ক্ষিতীশ। ভােরবেলার ট্রেন তাকে যে করেই হােক ধরতে হবে। হালকা জ্যোৎযায় নদীর ধার দিয়ে হাঁটছিল ক্ষিতীশ। যেন ঢেউগুলাে কথা বলছিল পরস্পরের মধ্যে। যেন হাসি আর পারুল পরস্পরে কথা বলছে। ক্ষিতীশ ঘাের-লাগা দৃষ্টি মেলে দেখছে দুটো রুপােলি রংয়ের ইলিশ মাছ যেন জলের উপর দিয়ে শির জাগিয়ে মােহনার দিকে চলে যাচ্ছে। অথচ ক্ষিতীশ কোনােদিন মাহনার সন্ধান পেল না। বীজ ছাড়ার মুহূর্তে ঘুর্ণিজলে ভেসে গেল তার স্বপ্ন।
কেবল তার বেলায় কেমন এমন হয়। দুপুরের রােদে ঘেমে গিয়েছিল ক্ষিতীশ তা বুঝতে পারেনি। রাধারানি হােটেলের কামিনী তাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, ও ক্ষিতীশদা, ভেতরে এসাে। আজ সর্ষে ইলিশ বেঁধেছি, খেয়ে যাও। কামিনীর স্বর্ণচাপা গায়ের রংয়ে লাবণ্য চলকে পড়ছিল। এত কিছুর পরেও ক্ষিতীশের মুগ্ধ চোখ আটকে গেল কামিনীর চোখে। ওর সারা শরীর থেকে ভেসে এল ইলিশের গন্ধ। আর এই গন্ধই সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াল তাকে। লাটিম বেঁচে আছে কিনা সে জানে না। এত রক্তপাতের পর তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কাজটা কোকের মাথায় করে ফেলে ভীষণ অনুতপ্ত ক্ষিতীশ। লাটিম হয়তাে তার বস্তিতে হাসিকে নিয়ে যেত। ঘর বাধত। সে সব আর হল না। মুখে রং মেখে হাসি কে আবার দাঁড়াতে হবে নদীর ধারে। আবার সে কারাের জন্য ইলিশ কিনে সর্যে দিয়ে রাধবে। নদী ছুঁয়ে বয়ে যাবে কত জল। খড়কুটোর মতাে ভেসে যাবে জীবনও। ধরা পড়ার ভয়ে ক্ষিতীশ পালিয়ে বেড়াবে এক নদী থেকে আরেক নদীতে। শুধু নাম বদলে যাবে নদীগুলাের। হাসি নদী, কামিনী নদী, পারুল নদী। তবু তুপ্তিতে কানায় কানায় উপচে পড়বে না জীবন।। কাটা মাটির গহরে লুকিয়ে থাকা সাপের মতাে বয়ে বেড়াতে হবে জীবন। কখনও পুরনাে খােলস ছেড়ে আবার নতুন জীবন। এক আদিম নেশায় নদীর মতাে ঢেউ ভাঙছে ক্ষিতীশ। ইলিশগন্ধে পাগল ক্ষিতীশ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খুঁজে যাবে সেই রুপােলি ইলিশ, যার মােহনা হবে ক্ষিতীশ। নিজেই।
——————————————