Bangla Love Story(ভালবাসার গল্প)
স্পন্দন
(সজ্ঞয় দাশগুপ্ত)
মেয়েটিকে একবার, জাস্ট একবার,
স্পর্শ
করতে তীব্রভাবে ইচ্ছে করছিল নীলার্কর।
ইচ্ছেটা তিরতির করে প্রবাহিত হচ্ছিল মনের নিভৃত কোণে, হালকা একটা পাহাড়ি ঝরনার মতো! দেখতে-দেখতে ঝরনা ফুলে ফেঁপে জলপ্রপাত। এই
মুহূর্তে, বুকের মধ্যে আটকে পড়া একটা বাজপাখির মতো! অস্থিরভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে ইচ্ছেটা।
সে যে ঠিক কোথায় তাই তো সে বুঝতে পারছে না! বোঝার চেষ্টাও করছে না অবশ্য ।
সে যে ঠিক কোথায় তাই তো সে বুঝতে পারছে না! বোঝার চেষ্টাও করছে না অবশ্য ।
ইচ্ছেটা তাকে অস্থির
করে তুলেছে! মেয়েটিকে একবার ছুঁতে চায় সে। শালীনতার মাত্রা লঙ্ঘন নয়, শুধু মেয়েটির ঘন, কালো, রেশমের
মতো চুলে একবার হাত বুলিয়ে, মুখের বাঁদিক থেকে চুলটা সরিয়ে দেবে।
মেয়েটি নিশ্চয় তখন ঘুরে তাকাবে তার দিকে! তা হলেই
তো তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে নীলার্ক। বুঝতে পারবে মেয়েটিকে
সে চেনে কি না! কোথাও দেখেছে কি না!
কী অপূর্ব নারীমূর্তি! একটা ঘন নীল কাঞ্জিভরম পরেছে যুবতী। মুখটা সমুদ্রের দিকে ঘোরানো।
সমুদ্রতটের উন্মাদ হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। ফ্লোরেন্সে দেখা শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো নিটোল হাতের গড়ন। একটা হাতই এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে নীলার্ক। সেতারের ডাঁটি স্পর্শ করে আছে যে হাত। মেয়েটি সেতার বাজাচ্ছে। রাতের চাঁদোয়া মাহোময় হয়ে উঠেছে সেতারের মুর্ছনায়। ভৈরবীর আলাপ। এখন কি তা হলে ভোর হবে? নিশ্চয়ই তাই! না হলে চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা রাতে ভৈরবী বাজাবে কেন এই যুবতী? সকলে কি তার মতো শিহরিত হচ্ছে বাজনা শুনে? কী অসামান্য হাত মেয়েটির! ঠিক যেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার বাজছে! প্রতিটি টঙ্কার, সুরের প্রতিটি মোচড় যেন নীলার্কর শরীরে ঢেউ তুলছে। কানের কাছে সুরের স্পন্দন টের পাচ্ছে সে। বাড়ছে...স্পন্দনটা বাড়ছে... বিদ্যুতের মতো একটা স্পষ্ট শিহরণ।।
ধড়মড় করে উঠে বসল নীলার্ক! বালিশের তলায় ফোনের কম্পন! তার স্মার্টফোন ভাইব্রেট করছে। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভৈরবী। এই বাজনাটাই তাহলে শুনছিল নীলার্ক! উপহার পাওয়া দামি এই স্মার্টফোনটির মধ্যে একটা আস্ত আইপড ঢোকানো আছে। তাতে মর্নিং রাগাস' বলে একটা ফাইল তৈরি করে এই ভৈরবীটা তো সে নিজেই সেভ করে রেখেছিল।
বালিশের তলায় হাত দিয়ে ফোনটা টেনে নিল নীলার্ক। হালকা নীল আলোয় উদ্ভাসিত স্ক্রিন। তাতে ডানদিকে থেকে বাঁদিকে সরে-সরে যাচ্ছে ইংরেজি অক্ষরগুলি, ৪:৪৫ এ এম! গুড মনিং। ওয়েক আপ ফ্রম ইয়োর ড্রিমস৷ ৪:৪৫ এ এম! গুড মনিং। ওয়েক আপ ফ্রম ইয়োর ড্রিমস..." জানালার কাচে এখনও শীতের রাত্রি লেগে রয়েছে। ভোর হয়ে যাবে এখন! সে স্বপ্ন দেখছিল! আর যন্ত্রটা সেটা জেনে গিয়েছে। ঠিক যেভাবে নীলার জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি, তার পছন্দ-অপছন্দ, এমনকী তার মনের গভীরতম আর্তিগুলি একটু-একটু করে জেনে ফেলেছে এই যন্ত্রটা!
লোকে জানে সে এই স্মার্টফোনটির মালিক! বহুমূল্য এই স্মার্টফোনটা তার বিবাহবার্ষিকীতে পাওয়া উপহার। কিন্তু নীলা নিজে এখন আর নিশ্চিত নয়!
বিশেষত সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে... যে ঘটনার পিছনের কাহিনি সে আর তার স্মার্টফোন ছাড়া আর কেউ জানে না। সেই হিসেবে এই। স্মার্টফোনটায় এখন তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু! বন্ধুই তো? নাকি শত্রু? নাকি মালিক? না হলে সেদিন সে নিজে, সচেতন দক্ষতায়, স্রেফ একটা স্মার্টফোন অ্যাপের নির্দেশ অনুযায়ী ওরকম একটা কাজ করে ফেলল কীভাবে? কথাটা মনে হতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল নীলার্কর। না, ওই ঘটনাটা নিয়ে সে কিছুতেই আর ভাববে না !
তা হলে পাগল হয়ে যেতে হবে! নিজেকে ধাক্কা দিয়ে সে মন থেকে সরিয়ে দিল চিন্তাটা জোর করে।
পাশে অরিত্রিকা এখনও গভীর ঘুমে। তার দিকে একটু কাত হয়ে শুয়ে আছে। ফিনফিনে রাতপোশাকের তলায় সুডৌল দুটি স্তনের মৃদু ওঠাপড়া। মোমের মতো ফরসা দুটি বাহু। অন্য দিন হলে হয়তো স্পর্শ করত নীলার্ক। আদর করে জাগানোর চেষ্টা করত অরিত্রিকাকে।
আজ তার বিস্ফারিত দৃষ্টি ফোনের পরদার উপর নিবদ্ধ। সে কি গত রাতে ভুল সময়ে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে ছিল?
নীলার্ক অফিসে এখন সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ। সম্প্রতি পদোন্নতি হয়েছে তার। একটি নামকরা বেসরকারি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সে। অরিত্রিকার স্কুলও সল্টলেকের মধ্যেই করুণাময়ীর কাছে। তাদের সি জি ব্লকের বাড়ি থেকে প্রায় হাঁটা পথ। এত ভোরে ওঠার প্রয়োজন হয় না তাদের। একতলায় মা বাবাও ছ'টার আগে ওঠেন না। নীলার্কর বাবা নীহারবিন্দু চট্টোপাধ্যায় রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার হয়ে রিটায়ার করেছেন। মা, নীলিমা কোনও দিন চাকরি করেননি। নিপাট করে সংসার চালান তিনি। এখনও, এই বয়সেও। ফোনের ভাইব্রেশনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে যন্ত্রটা হাতে নেওয়ামাত্রই। এটা এই মুহূর্তে বাজারে সবচেয়ে দামি মডেল। কোনও পাসওয়ার্ডও লাগে না এই ফোনটাতে, নীলার আঙুলের ছাপ স্ক্যান করে নিজের মেমরিতে সেভ করে রেখেছে যন্ত্রটা। সে ফোন হাতে নিলেই তার আঙুলের ছাপ নিয়ে, সেভ করা স্ক্যানের সঙ্গে মিলিয়ে নেয় স্মার্টফোন। ছাপে ছাপে মিলে গেলে, ফোন তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিড করলে জেগে ওঠে মন্ত্র। স্ক্রিনে আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু এই স্বপ্নের ব্যাপারটা মারাত্মক। হাজার হলেও একটা যন্ত্র তো! যন্ত্র টের পায় কী করে যে সে স্বপ্ন দেখছে? এটা নিশ্চয় সেই ‘অ্যাপটার কারসাজি! মাসখানেক আগে, নিছক। কৌতূহলবশে ‘অ্যাপটা ডাউনলোড করার সময়, নীলার কি ধারণা ছিল কোন জগতে প্রবেশ করতে চলেছে সে? বুঝতে পারল সেদিনের ঘটনাটার পর। রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে অফিস যাওয়ার পথে।
"কী গো এর মধ্যে উঠে পড়লে নাকি? উমম.-
কটা বাজে ? আর-একটু ঘুমাও। এসো..."
তন্ত্রা জড়িত কণ্ঠস্বর অরিত্রিকর। ঘুমন্ত হাত খুঁজছে তাকে।
"নাঃ তুমি ঘুমোও।"
ফোনটা হাতে নিয়েই বারান্দায় বেরিয়ে এল নীলার্ক। বেডরুমের দরজাটা টেনে দিল আলো করে। আর-একটু ঘুমিয়ে নিক অরিত্রিকা। একটু আদর করলে হত। সাতসকালে একটা অবাধ্য হচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই সেটাকে দমন করল নীলার্ক। এখনও তাদের দাম্পত্য পুরনো হয়নি। অক্টোবর মাসে তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী গেল। বিবাহবার্ষিকীতেই আর্তি তাকে উপহার দিয়েছিল দামি এই সেটটা, স্মার্টফোন আর স্মার্টওয়াচ। একটা নাকি অন্যটার সঙ্গে কথা বলে। আর্তি অরিত্রিকাকেও একটা স্মার্টওয়াচ দিয়েছিল। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম এ করার সময় বিহারের মেয়ে আর্তি দুমারের সঙ্গে পরিচয় নীলার্কর। আর্তি তখন আইআইটি দিল্লির ছাত্রী। একটা স্টুডেন্ট ফেস্টে তাদের আলাপ। ছিপছিপে, কৃষ্ণাঙ্গী, এবং অসামান্যা সুন্দরী আর্তি। ঝকঝকে দুটি টানা টানা চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। আসানসোলে বড় হয়েছে, তার বাবা ছিলেন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। তাই আর্তির বাংলায় কোন জড়তা নেই। শুধু, তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ। আলাপ থেকে সম্পর্কটা প্রেমে গড়াতে খুব বেশি সময় নেয়নি। দু’টি পরিবারেই তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি ছিল। তবে নীলার্কর মায়ের দিক থেকেই বেশি। ছেলে অন্য সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করতে বদ্ধপরিকর দেখে দু’বার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন নীলিমা। দ্বিতীয়বার নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে প্রায় সফলও হয়ে গিয়েছিলেন। ফর্টি পার্সেন্ট বার্নস নিয়ে দশদিন হাসপাতালে ছিলেন। যমে-মানুষে অনেক টানাটানির পরে। একটু-একটু করে উঠে বসেছিলেন। সেই ঘটনার পরে, আর্তি এবং নীলার্ক দুজনেই পিছিয়ে আসে। সেদিন বহুক্ষণ কেঁদেছিল আর্তি। তারা দেখা করেছিল জেএনইউ ক্যাম্পাসেই। নীলার্কর আজও মনে পড়ে জেএনইউ-এর রুক্ষ জঙ্গলে ঘেরা বিজন প্রান্তে আর্তির সেই গভীর, নীরব অশ্রুপাত। দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝুঁকে বসে আছে। সপ্রতিভ নারী। রুদ্ধ বাষ্পে কেঁপে-কেঁপে উঠছে পিঠের রেখা। সেই আর্তি তাদের বিবাহবার্ষিকীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে এসেছিল। নীহারবিন্দুই দেখেশুনে অরিত্রিকাকে নিয়ে এসেছেন এ বাড়িতে। সম্বন্ধ করে বিয়ে করার ব্যাপারে নীলার্ক খুব একটা আপত্তি করেনি। কিন্তু অরিত্রিকার কাছে গোপনও করেনি কিছু।
বউয়ের উৎসাহেই খোঁজখবর নিয়ে আর্তিকে বিবাহবার্ষিকীতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ই মেল করেছিল নীলার্ক। আর্তি ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছে। সে যে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এতদূর আসবে এটা সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু এসেছিল আর্তি। হাতে বহুমূল্য উপহার। আর্তি আসছে শুনে মুখ টিপে হেসেছিল অরিত্রিকা, কিন্তু আর্তির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তারও খুব ভাল লেগেছিল আর্তিকে। এখন আর্মির সঙ্গে ইমেলে যোগাযোগ রাখে অরিত্রিকা। আর্তির দেওয়া স্মার্টফোন পরদিন থেকেই ব্যবহার করতে শুরু করে নীলার্ক। প্রথমদিকে তো বেশ চলছিল সবকিছু। মাসখানেক পর একদিন তার স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা নতুন অ্যাপের বিজ্ঞাপন। অ্যাপ-টার নাম প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার, 'অ্যাপ ফর এভরিথিং। সবকিছুর অ্যাপ! সেটা আবার কী বস্তু?
স্মার্ট ফোনে বিভিন্ন বিষয়ের আলাদা-আলাদা অ্যাপ ডাউনলোড করা যায়, এমনটাই জানে নীলার্ক। কোনওটা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত অ্যাপ, ব্লাড প্রেশার, ব্লাড শুগার, ক’পা হেঁটেছ, কপা দেীড়েছ, বলে দেবে। কোনওটা খবরের অ্যাপ, কোনওটা গেমস খেলার অ্যাপ, কোনওটা আবার ডেটিং অ্যাপ, বান্ধবী খুঁজে দেবে তোমায়। এসব জানে নীলার্ক। কিন্তু অ্যাপ ফর এভরিথিং-টা নতুন। সবকিছুর অ্যাপ সে আগে দেখেনি। নামটা দেখেই কৌতূহলের বশে ডাউনলোড করে নিয়েছিল। প্রথম কয়েকদিন কোনও সাড়া দেয়নি অ্যাপটি। ঘটনা ঘটতে শুরু করল মাসতিনেক আগে, একদিন অফিস যাওয়ার পথে।
সি
জি ব্লক থেকে বেরিয়ে অভ্যেসমতো সোজা করুণাময়ীর রাস্তা
ধরেছে নীলার্ক। করুণাময়ী ডান হাতে রেখে কিছুটা এগোলেই একটা মোড়ে। সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরবে
নীলার্কর গাড়ি। করুণাময়ী তখনও পৌঁছায়নি নীলার্ক, হঠাৎ কেঁপে উঠেছে পাশের সিটে রাখা
স্মার্টফোন। পরদায় নীলাভ দ্যুতি। সঙ্গে সুললিত
রমাকণ্ঠের আওয়াজ "আফটার ওয়ান হানড্রেড মিটার টার্ন লেফট।
আফটার ওয়ান হানড্রেড মিটার্স টার্ন লেফট। ট্রাফিক প্রবলেমস অ্যাহেড।”
আড়চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়েছিল নিলার্ক। মনে-মনে যন্ত্রটার তারিফও করেছিল হয়ত। কিন্তু পাত্তা দেয়নি সেই নির্দেশকে। অভ্যস্ত পথেই এগিয়েছিল গাড়ি নিয়ে। ফলত সেদিন দেড় ঘন্টা দেরি হয়ে গিয়েছিল অফিসে ঢুকতে, যেটা নীলার্ক প্রায় কখনও হয় না।
করুণাময়ীর সামনে থেকে সেই যে যানজট শুরু হল, সেটা চলল প্রায় সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত।
কোনও একটা
রাজনৈতিক দলের তিন দিন পরে আবার যখন অফিস যাওয়ার পথে কেঁপে
উঠেছে যন্ত্র, বলে উঠেছে,
"অ্যাট রাউন্ড অ্যাবাউট, টার্ন রাইট," সেদিন আর দ্বিরুত্তি
করেনি নীলার্ক। ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে স্মার্টফোন নির্দেশিত পথে অফিস পৌছেছে সে। নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই। গত তিনমাসে এ ঘটনা
ঘটেছে আটবার। শুধু অফিস যাওয়ার সময় নয়।
কলকাতা শহরে গাড়ি নিয়ে চলাফেরার নানা অবকাশে
ভাইব্রেট
করে উঠেছে স্মার্টফোন। কথা বলে উঠেছে রমাকণ্ঠ। “টার্ন লেফট, ট্র্যাফিক প্রবলেমস অ্যাহেড, টার্ন রাইট, রোড ওয়ার্কস থ্রি হানড্রেড মিটার্স অ্যাহেড, প্ল্যানিং নিউ রুট, রোড ক্লোজড।” এবার নিজের উপরই বিরক্ত হয়েছে নীলার্ক। এটা কি অভ্যেসে পরিণত হচ্ছে তার? একটা যন্ত্রের উপর এই একান্ত নির্ভরশীলতা? নীলার্ক চট্টোপাধ্যায়ের, যে কিনা ব্যাঙ্কিং সেক্টরের উদীয়মান তারকা? পরপর তিনবার নিজের উপর অগাধ আস্থায়, যন্ত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করেছিল সে। তিনবারই অপরিণামদর্শিতার মাশুল গুনতে হয়েছিল তাকে। অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অফ কমার্সের ডিনারে পৌঁছেছিল একঘণ্টা দেরিতে, তখন কি-নোট অ্যাড্রেস হয়ে গিয়েছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে তাদের ব্যাঙ্কের জোনাল অফিসে বড়কর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা পরে হাঁফাতে-হাঁফাতে ঢুকেছিল। বেহালায় তার সহকর্মীর বিয়েতে তো আর গিয়ে উঠতেই পারেনি, নিউ আলিপুরের কাছে তিনঘন্টা জ্যামে আটকে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপর আর এই অসম লড়াইটা চালু রাখেনি নীলার্ক। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরলে হলে তখন তার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ স্মার্টফোনের কাছে। সেদিন
ফোরামে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়, রমা কণ্ঠের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশ এবং নীলা্কর অনুপুক্স অনুসরণ দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল অরিত্রিকা। এত ঘুরে যাচ্ছ"
"মরে যাচ্ছি বলেই সময়মতো পৌঁছাতে পারব। শুরুটা মিস করব না। দ্যাখো না।”
কথার খেলাপ করেনি নীলার্ক। শো-এর আগে পৌঁছেছিল তারা। পার্কিংটুকু নীলার্ক করেছিল ফোনের নির্দেশ মেনে। বাব্বা! আমার কথা যদি এভাবে শুনতে।” অরিত্রিকার অভিযাগে শুনে হেসে ফেলেছিল নীলার্ক। "তোমার কোন কথাটা শুনিনি বলো তো?" কিন্তু সাতসকালে উঠে মোবাইল ফোন নিয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে কেন শুরু করল সে? নিজেকে মৃদু ধমক দিল নীলার্ক। সল্টলেকে শীতের ভোর ভারী সুন্দর। বাড়ির ছোট্ট লনে চিকচিক করছে শিশির। কিচিরমিচির করে চড়াই পাখিদের ব্রেকফাস্ট মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। অরিত্রিকা বাগান করে মন দিয়ে। বড় বড় ডালিয়া ফুটিয়েছে এবার, গভীর নীল, উজ্বল। হলুদ, ধবধবে সাদা। নিলু উঠে পড়েছিস নাকি? চা দেব?" মায়ের গলা। দ্রুত নীচের দিকে পা বাড়াল নীলার্ক।। আর দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নামতে-নামতে মনে পড়ল আর-এক দিনের কথা। সেদিনও সে নীচে নামছে। “ইউ নিড টু গো ডাউন টু ফ্লোরস। এগজিট অন দ্য থার্ড ফ্লোর, দেন টার্ন লেফট। এগজিট দ্য থার্ড ফ্লোর, দেন টার্ন লেফট।” দক্ষিণ কলকাতার ঝাঁ চকচকে শপিংমলটা বেশ কয়েকটা তলা জুড়ে। একেবারে উপরের তলায় নীলাকদের ব্যাঙ্কের একটা শাখা খোলা হয়েছে। সেখানেই একটা মিটিং-এ এসেছিল সে। নীচে কার-পার্কে যাওয়ার জন্য লিফটে উঠেই কোটের ডান পকেটে ফোনের স্পন্দন টের পেল। সঙ্গে খুব নিম্নস্বরে রমাকণ্ঠের নির্দেশ। কিছুটা কৌতুহলের বশেই অ্যাপের কথা শুনে এগিয়েছিল নীলা। শপিংমলের চারতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ডানদিক, বাঁদিকে নানা মোড় নেওয়ার পর, অ্যাপ তাকে এনে ফেলেছে। একটা ফুলের দোকানের সামনে। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে, ভরদুপুরে হঠাৎ ফ্লোরিস্টের দোকানে কী করবে সে? বিরক্ত হয়ে ডানহাতের মুঠোয় ধরা ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখল স্ক্রিনের উপর চলমান হরফের মিছিল, টুডে, ডিসেম্বর এইটিঙ্ক, অমিয়নাথ লাহিডিজ এইট্টিয়েথ বার্থডে, প্লিজ অর্ডার আবার কে...
অমিয়নাথ লাহিড়ী! অরিত্রিকার বাবার জন্মদিন!, কোন মুহূর্তে আরও পাঁচজনের মতো তার শ্বশুরমশাই-এর ঠিকানাসহ নানা খুঁটিনাটি সেভ করে রেখেছিল কে জানে! জন্মতারিখটাও সেভ করা ছিল নিশ্চয়, না হলে অ্যাপ সেটা খুঁজে বের করবে কী করে! কিন্তু গুল লোকেটারে তার অবস্থান নির্ধারণ করে, সে কোথায় আছে ঠিকমতো হিসেব করে, তাকে ফুলের দোকানের সামনে এনে ফেলে, রিমাইন্ডার দেওয়া, একেবারে অসামান্য! মনে মনে তারিফ না করে পারেনি নীলার্ক। তার বাবার জন্মদিন মনে রেখে, সাদা গোলাপের বোকে আর কেক নিয়ে হাজির হবে নীলার্ক, এতটা ভাবতেই পারেনি অরিত্রিকা।। খুব খুশি হয়েছিলেন শ্বশুর-শাশুড়িও। অরিত্রিকাদের গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে বেশ হইহই করে কেটেছিল সন্ধেটা। সেদিন গভীর রাতে উপছে পড়া খুশিতে অরিত্রিকার উন্মুখ মিলনের রেশটা বেশ কয়েকদিন শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিল। মনে আছে আর-এক দিনের কথাও, কিন্তু সে কথাটা কাউকে বলতে পারেনি নীলার্ক। আজও, এতদিন পরেও না। যে ঘটনাগুলো সে ভুলতে চায়, এটা তার মধ্যে একটা। কিন্তু ভোলা কি সহজ? তার ব্যাঙ্কের উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং এর জন্য দিল্লি গিয়েছিল নীলার্ক। থাকার ব্যবস্থা করেছিল অফিস থেকেই, দিল্লির একটা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে। সারা দিনের ব্যস্ততার শেষে হোটেলের বারে বসে একাই মদ্যপান করছিল নীলার্ক। একটু পরেই অফিসের বড় সাহেবদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ। তার আগে এই ঘন্টা দুয়েক সময় তার একান্ত নিজস্ব। পাঁচতারা হোটেলের মনোরম বার। দেওয়ালে ছোঁট-বড় নানা মাপের রাজস্থানি পেন্টিং, মুঘল মিনিয়েচার। নীল আলো, সবুজ আলোর হালকা উকিঝুকি। সেতারের মৃদু ঝংকার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন সুসজ্জিত নারী-পুরুষ। মোহময়, রুচিশীল পরিবেশ। ব্যস্ত দিনের শেষে একা বসেছিল পাত্র নিয়ে, পানের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে থাকবে হয়তো। ঠিক কটা জিন অ্যান্ড টনিকের পর ঘটেছিল ঘটনাটা এখন আর তা মনে নেই নীলার্কর। শুধু মনে আছে আমার পকেটে স্মার্টফোনের থিরিথিরি কম্পন। তার স্মার্টফোনের স্ক্রিন জেগে উঠেছে। পরদায় ফুটে ওঠা অভ্বুত বার্তাটা বারদুয়েক পড়ল নীলার্ক। কয়েক পাত্র পেটে পড়ার ফলে সে ভুল দেখছে না তো? "সামওয়ান লাইক ইউ দিস ইভনিং। শি ইজ ইন দিস এরিয়া। ওয়ান্ট টু নো মোর? সে সচেতন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই অবাধ্য আঙুল ইয়েস টিপে দিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ফুটে উঠল না পরদায়। শুধু নীলাভ আলোর বিকিরণ। ফোনটা আবার পকেটে রেখে। দিতে যাবে, ঠিক তখনই আবার কম্পন। এবারে সরাসরি কেউ বার্তা পাঠাচ্ছে তাকে, "হাই, আযযাম ফিলিং হর্নি। মাই ফোন টোল্ড ইউ আর টু! ওয়ানা মিট?” স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, প্রস্তাব। কোনও জড়তা নেই, কোন রাখঢাক বালাই নেই! এরকম আবার হয় নাকি? বারটিতে ছড়িয়েছিটিয়ে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুন্দরী তরুণী। কয়েকজন বিদেশিনীও আছেন। অনেকেই বেশ স্বল্পবাস। তাদের দিকে তাকিয়ে যে-কোনও পুরুষেরই নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হতে বাধ্য। নীলার্ক তার ব্যতিক্রম হবে কী করে? কিন্তু সে কথাটা তার স্মার্টফোন জানল কীভাবে? আর শুধু জানা নয়, আর-একজনকে জানিয়েও দিল কথাটা? এ-ও কি সেই অ্যাপ? উন্মুখ কোন। নারীর কাছে নিয়ে যাচ্ছে তাকে?
“তুমি কে?” কৌতুহল তার আঙুল দিয়ে লেখাল কথাটা। “আমি নারী আর আমার পুরুষ দরকার!” আবারও দ্বিধাহীন উত্তর। এবারে একটু সতর্ক হল নীলার্ক। “বাট হোয়াই মি? আমায় কেন?” কথোপকথন যত এগোচ্ছে, তত বিস্মিত হচ্ছে নীলার্ক। "আই ক্যান সি ইউ। হোয়াইট শার্ট, ডার্ক ব্ল ট্রাউজার্স। হ্যান্ডসাম!” নীলার্ককে হতচকিত হয়ে মুখ তুলে তাকাতে দেখে উলটোদিকের কোণে একা বসে থাকা এক শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী অল্প একটু মাথা হেলাল। সকলের অলক্ষে ঠোঁটে কি একচিলতে হাসি? এতদূর থেকে বুঝতে পারছে না নীলার্ক।। এ যে অবিশ্বাস্য। “ডিড ইউ জাস্ট নড়? তুমি কি মাথা হেলালে?” ইয়েস। ক্যান আই কাম অ্যান্ড সে হ্যালো?
করে উঠেছে স্মার্টফোন। কথা বলে উঠেছে রমাকণ্ঠ। “টার্ন লেফট, ট্র্যাফিক প্রবলেমস অ্যাহেড, টার্ন রাইট, রোড ওয়ার্কস থ্রি হানড্রেড মিটার্স অ্যাহেড, প্ল্যানিং নিউ রুট, রোড ক্লোজড।” এবার নিজের উপরই বিরক্ত হয়েছে নীলার্ক। এটা কি অভ্যেসে পরিণত হচ্ছে তার? একটা যন্ত্রের উপর এই একান্ত নির্ভরশীলতা? নীলার্ক চট্টোপাধ্যায়ের, যে কিনা ব্যাঙ্কিং সেক্টরের উদীয়মান তারকা? পরপর তিনবার নিজের উপর অগাধ আস্থায়, যন্ত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করেছিল সে। তিনবারই অপরিণামদর্শিতার মাশুল গুনতে হয়েছিল তাকে। অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অফ কমার্সের ডিনারে পৌঁছেছিল একঘণ্টা দেরিতে, তখন কি-নোট অ্যাড্রেস হয়ে গিয়েছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে তাদের ব্যাঙ্কের জোনাল অফিসে বড়কর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা পরে হাঁফাতে-হাঁফাতে ঢুকেছিল। বেহালায় তার সহকর্মীর বিয়েতে তো আর গিয়ে উঠতেই পারেনি, নিউ আলিপুরের কাছে তিনঘন্টা জ্যামে আটকে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপর আর এই অসম লড়াইটা চালু রাখেনি নীলার্ক। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরলে হলে তখন তার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ স্মার্টফোনের কাছে। সেদিন
ফোরামে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়, রমা কণ্ঠের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশ এবং নীলা্কর অনুপুক্স অনুসরণ দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল অরিত্রিকা। এত ঘুরে যাচ্ছ"
"মরে যাচ্ছি বলেই সময়মতো পৌঁছাতে পারব। শুরুটা মিস করব না। দ্যাখো না।”
কথার খেলাপ করেনি নীলার্ক। শো-এর আগে পৌঁছেছিল তারা। পার্কিংটুকু নীলার্ক করেছিল ফোনের নির্দেশ মেনে। বাব্বা! আমার কথা যদি এভাবে শুনতে।” অরিত্রিকার অভিযাগে শুনে হেসে ফেলেছিল নীলার্ক। "তোমার কোন কথাটা শুনিনি বলো তো?" কিন্তু সাতসকালে উঠে মোবাইল ফোন নিয়ে এসব সাতপাঁচ ভাবতে কেন শুরু করল সে? নিজেকে মৃদু ধমক দিল নীলার্ক। সল্টলেকে শীতের ভোর ভারী সুন্দর। বাড়ির ছোট্ট লনে চিকচিক করছে শিশির। কিচিরমিচির করে চড়াই পাখিদের ব্রেকফাস্ট মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। অরিত্রিকা বাগান করে মন দিয়ে। বড় বড় ডালিয়া ফুটিয়েছে এবার, গভীর নীল, উজ্বল। হলুদ, ধবধবে সাদা। নিলু উঠে পড়েছিস নাকি? চা দেব?" মায়ের গলা। দ্রুত নীচের দিকে পা বাড়াল নীলার্ক।। আর দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নামতে-নামতে মনে পড়ল আর-এক দিনের কথা। সেদিনও সে নীচে নামছে। “ইউ নিড টু গো ডাউন টু ফ্লোরস। এগজিট অন দ্য থার্ড ফ্লোর, দেন টার্ন লেফট। এগজিট দ্য থার্ড ফ্লোর, দেন টার্ন লেফট।” দক্ষিণ কলকাতার ঝাঁ চকচকে শপিংমলটা বেশ কয়েকটা তলা জুড়ে। একেবারে উপরের তলায় নীলাকদের ব্যাঙ্কের একটা শাখা খোলা হয়েছে। সেখানেই একটা মিটিং-এ এসেছিল সে। নীচে কার-পার্কে যাওয়ার জন্য লিফটে উঠেই কোটের ডান পকেটে ফোনের স্পন্দন টের পেল। সঙ্গে খুব নিম্নস্বরে রমাকণ্ঠের নির্দেশ। কিছুটা কৌতুহলের বশেই অ্যাপের কথা শুনে এগিয়েছিল নীলা। শপিংমলের চারতলায় লিফট থেকে বেরিয়ে ডানদিক, বাঁদিকে নানা মোড় নেওয়ার পর, অ্যাপ তাকে এনে ফেলেছে। একটা ফুলের দোকানের সামনে। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে, ভরদুপুরে হঠাৎ ফ্লোরিস্টের দোকানে কী করবে সে? বিরক্ত হয়ে ডানহাতের মুঠোয় ধরা ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখল স্ক্রিনের উপর চলমান হরফের মিছিল, টুডে, ডিসেম্বর এইটিঙ্ক, অমিয়নাথ লাহিডিজ এইট্টিয়েথ বার্থডে, প্লিজ অর্ডার আবার কে...
অমিয়নাথ লাহিড়ী! অরিত্রিকার বাবার জন্মদিন!, কোন মুহূর্তে আরও পাঁচজনের মতো তার শ্বশুরমশাই-এর ঠিকানাসহ নানা খুঁটিনাটি সেভ করে রেখেছিল কে জানে! জন্মতারিখটাও সেভ করা ছিল নিশ্চয়, না হলে অ্যাপ সেটা খুঁজে বের করবে কী করে! কিন্তু গুল লোকেটারে তার অবস্থান নির্ধারণ করে, সে কোথায় আছে ঠিকমতো হিসেব করে, তাকে ফুলের দোকানের সামনে এনে ফেলে, রিমাইন্ডার দেওয়া, একেবারে অসামান্য! মনে মনে তারিফ না করে পারেনি নীলার্ক। তার বাবার জন্মদিন মনে রেখে, সাদা গোলাপের বোকে আর কেক নিয়ে হাজির হবে নীলার্ক, এতটা ভাবতেই পারেনি অরিত্রিকা।। খুব খুশি হয়েছিলেন শ্বশুর-শাশুড়িও। অরিত্রিকাদের গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে বেশ হইহই করে কেটেছিল সন্ধেটা। সেদিন গভীর রাতে উপছে পড়া খুশিতে অরিত্রিকার উন্মুখ মিলনের রেশটা বেশ কয়েকদিন শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিল। মনে আছে আর-এক দিনের কথাও, কিন্তু সে কথাটা কাউকে বলতে পারেনি নীলার্ক। আজও, এতদিন পরেও না। যে ঘটনাগুলো সে ভুলতে চায়, এটা তার মধ্যে একটা। কিন্তু ভোলা কি সহজ? তার ব্যাঙ্কের উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং এর জন্য দিল্লি গিয়েছিল নীলার্ক। থাকার ব্যবস্থা করেছিল অফিস থেকেই, দিল্লির একটা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে। সারা দিনের ব্যস্ততার শেষে হোটেলের বারে বসে একাই মদ্যপান করছিল নীলার্ক। একটু পরেই অফিসের বড় সাহেবদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ। তার আগে এই ঘন্টা দুয়েক সময় তার একান্ত নিজস্ব। পাঁচতারা হোটেলের মনোরম বার। দেওয়ালে ছোঁট-বড় নানা মাপের রাজস্থানি পেন্টিং, মুঘল মিনিয়েচার। নীল আলো, সবুজ আলোর হালকা উকিঝুকি। সেতারের মৃদু ঝংকার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন সুসজ্জিত নারী-পুরুষ। মোহময়, রুচিশীল পরিবেশ। ব্যস্ত দিনের শেষে একা বসেছিল পাত্র নিয়ে, পানের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে থাকবে হয়তো। ঠিক কটা জিন অ্যান্ড টনিকের পর ঘটেছিল ঘটনাটা এখন আর তা মনে নেই নীলার্কর। শুধু মনে আছে আমার পকেটে স্মার্টফোনের থিরিথিরি কম্পন। তার স্মার্টফোনের স্ক্রিন জেগে উঠেছে। পরদায় ফুটে ওঠা অভ্বুত বার্তাটা বারদুয়েক পড়ল নীলার্ক। কয়েক পাত্র পেটে পড়ার ফলে সে ভুল দেখছে না তো? "সামওয়ান লাইক ইউ দিস ইভনিং। শি ইজ ইন দিস এরিয়া। ওয়ান্ট টু নো মোর? সে সচেতন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই অবাধ্য আঙুল ইয়েস টিপে দিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ফুটে উঠল না পরদায়। শুধু নীলাভ আলোর বিকিরণ। ফোনটা আবার পকেটে রেখে। দিতে যাবে, ঠিক তখনই আবার কম্পন। এবারে সরাসরি কেউ বার্তা পাঠাচ্ছে তাকে, "হাই, আযযাম ফিলিং হর্নি। মাই ফোন টোল্ড ইউ আর টু! ওয়ানা মিট?” স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, প্রস্তাব। কোনও জড়তা নেই, কোন রাখঢাক বালাই নেই! এরকম আবার হয় নাকি? বারটিতে ছড়িয়েছিটিয়ে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুন্দরী তরুণী। কয়েকজন বিদেশিনীও আছেন। অনেকেই বেশ স্বল্পবাস। তাদের দিকে তাকিয়ে যে-কোনও পুরুষেরই নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হতে বাধ্য। নীলার্ক তার ব্যতিক্রম হবে কী করে? কিন্তু সে কথাটা তার স্মার্টফোন জানল কীভাবে? আর শুধু জানা নয়, আর-একজনকে জানিয়েও দিল কথাটা? এ-ও কি সেই অ্যাপ? উন্মুখ কোন। নারীর কাছে নিয়ে যাচ্ছে তাকে?
“তুমি কে?” কৌতুহল তার আঙুল দিয়ে লেখাল কথাটা। “আমি নারী আর আমার পুরুষ দরকার!” আবারও দ্বিধাহীন উত্তর। এবারে একটু সতর্ক হল নীলার্ক। “বাট হোয়াই মি? আমায় কেন?” কথোপকথন যত এগোচ্ছে, তত বিস্মিত হচ্ছে নীলার্ক। "আই ক্যান সি ইউ। হোয়াইট শার্ট, ডার্ক ব্ল ট্রাউজার্স। হ্যান্ডসাম!” নীলার্ককে হতচকিত হয়ে মুখ তুলে তাকাতে দেখে উলটোদিকের কোণে একা বসে থাকা এক শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী অল্প একটু মাথা হেলাল। সকলের অলক্ষে ঠোঁটে কি একচিলতে হাসি? এতদূর থেকে বুঝতে পারছে না নীলার্ক।। এ যে অবিশ্বাস্য। “ডিড ইউ জাস্ট নড়? তুমি কি মাথা হেলালে?” ইয়েস। ক্যান আই কাম অ্যান্ড সে হ্যালো?
ড্রিংকস-এর
দাম মিটিয়ে উঠে পড়ার আগেই শ্বেতাঙ্গিনী এসে করমর্দন
করেছিল তার সঙ্গে। কোনও সময় নষ্ট না করে নিজের রুমে
নিয়ে গিয়েছিল নীলার্ককে। মেয়েটি ফরাসি। সদ্য আলাপের উচ্ছাসে
মিলিত হয়েছিল তারা। সে রাতটা বোধহয় আজীবন মনে থাকবে নীলার্কর। অভিনব অপরিচিতি আর আকস্মিকের উত্তেজনা। দুটি অপরিচিত শরীর একে অপরকে আবিষ্কারের আনন্দে উদ্দাম। কিন্তু তারপরেই ঝেপে বৃষ্টি নামার মতো
এসেছিল অপরাধবোধে। মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়
ওখানেই শেষ। কিন্তু তাতে কী? ঘটনাটা কার মতো বিধেছিল। বিশেষত তার স্মার্টফোন অ্যাপের ভূমিকাটা। তাই কলকাতায় ফিরেই দেখা করেছিল তার স্কুলের বন্ধু অয়নের সঙ্গে। টিসিএসে চাকরি
করে অয়ন। দীর্ঘদিন আমেরিকার হিউস্টন শহরে
কাটিয়ে বছরখানেক কলকাতায় ফিরেছে। বালিগঞ্জ
সার্কুলার রোডের কফিশপে বসে ক্যাপুচিনোয় আরামের চুমুক দিতে দিতে
তার। দুশ্চিন্তাকে পাত্তাই দেয়নি অয়ন।
"আরে! কী আশ্চর্য। তুই অ্যাপ ডাউনলোড করেছিস। সে মেয়েটাও কোন একটা কমপ্যাটিবল অ্যাপ ডাউনলোড করেছে, তা তাদের হরমোন লেভেল রিড করে দুটো অ্যাপ লিঙ্ক আপ করবে না? তা হলে অ্যাপ রেখে কী লাভ?"
“কিন্তু তা বলে, ওরকম মুহুর্তের মধ্যে,” এই মুহুর্তের মধ্যে না হলে কাজ হবে? অ্যাপ যদি একবছর লাগাত তাদের হরমোন ডেটা রিড করতে, দেখা হত তাদের? এটা অ্যালগরিদম-এর যুগ ব্রাদার। সবই আসলে অ্যালগরিদমের খেলা। এই যে তুই, আমি, এই কফির কাপটা, সবই আসলে এক-একটা অ্যালগরিদম। সবই শুধু ডেটা, শুধু তথ্য। এক একটা ক্ষেত্রে এক-একভাবে বিন্যস্ত ডেটা। এই তথ্য কে কীভাবে পড়তে পারছে, রিড করছে, প্রসেস করছে, তার উপর সবকিছু নির্ভর করে। যন্ত্র মানুষের থেকে অনেক গুণ তাড়াতাড়ি ডেটা রিড করে আর প্রসেস করে। এতে অবাক হচ্ছিস কেন?”
"আর আমার শ্বশুরের জন্মদিন? রোজ রাস্তা বলে দেওয়া?”
"এগুলো কোনও কথা হল? জন্মদিন সেভ করা থাকলে অ্যাপ অ্যালার্ট দেবে না তাকে? রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকলে স্যাটেলাইট ইমেজ স্ক্যান করে বলবে না? এগুলো তো বেসিক ব্যাপার। আরে গোরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ভুতের ওঝা, ঝাড়ফুঁকের যুগ তো আমরা পেরিয়ে এসেছি? নাকি? না, তুই খেয়াল করিস নি সেটা?”
কিন্তু এত সব সত্ত্বেও এর পরের দ্রুত-ঘটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না নীলার্ক কোনও একদিন তার অফিসের পিসি থেকে স্মার্টফোন চার্জ করেছিল সে। স্মার্টফোনের চার্জারটা অফিস কম্পিউটারের সিপিইউ তে ঢোকানোমাত্রই ফোন তাকে জিজ্ঞেস করে, “ট্রাস্ট দিস কম্পিউটার? আমি এই কম্পিউটারটিকে বিশ্বাস করতে পারি?” অফিসে, তার নিজের চেম্বারে বসানো কম্পিউটার। দ্বিরুক্তি না করে ইয়েস টিপে দিয়েছিল নীলার্ক। চার্জ শেষ হওয়ামাত্রই তার ফোন তাকে বলতে শুরু করে, ব্যাঙ্কে কোন কোন অ্যাকাউন্ট দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত, বা ডরম্যান্ট পড়ে আছে। সব ব্যাঙ্কেই কিছু-কিছু অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট, বা জীবন্মৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কেউ কখনও একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তারপর প্রযয়োজন ফুরিয়েছে, বা পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন, হয়তো বা শহর ছেড়েও, অথবা হয়ত মারাই গিয়েছেন কেউ, অ্যাকাউন্টটা আর বন্ধ করা হয়নি, ওভাবেই পড়ে আছে। কেউ টাকা তুলে বছরের পর বছর। টাকা ভরেও না। একের পর এক ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের সমস্ত খুঁটিনাটি ভেসে উঠতে আরম্ভ করেছে তার ফোনের পরদায় ।অ্যাকাউন্ট নম্বর, কতদিন ডরম্যান্ট আছে অ্যাকাউন্ট, কবে শেষ ব্যবহার হয়েছিল, কত টাকা আছে অ্যাকাউন্টে কিছু কিছু অ্যাকাউন্টে লক্ষ-লক্ষ টাকা ডরম্যান্ট হয়ে আছে। তার সঙ্গেই, মাঝে-মাঝে বলছে ফোন: “সেফ টু ট্রান্সফার ফ্রম দিস অ্যাকাউন্ট। স্টার্ট ট্রান্সফার?” অর্থাৎ এই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানো নিরাপদ। সরিয়ে ফেলব?
লোভ? কৌতূহল? কেন করেছিল জানে না নীলার্ক, কিন্তু পরপর কয়েকদিন ফোনের পরদায় এই প্রশ্ন দেখার পর একদিন হঠাৎ ইয়েস টিপে দিয়েছিল। বত্রিশ লাখ টাকার একটা ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট খালি করে তার অ্যাকাউন্টে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার স্মার্টফোন অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। সবকিছুর অ্যাপ। তারপর আরও দু'বার ঘটেছিল সেই ঘটনা। একবার পনেরো লক্ষ টাকা। একবার চব্বিশ লাখ।
সে তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।। ব্যাপারটা ঠিক কী ভাবে হল, সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মনসিজ সমাদ্দার। তা আজও জানে না নীলার্ক। দ্রুত একটা ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছিলেন তিনি। নীলার্কর তখন দিশেহারা অবস্থা। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় ধরা পড়ে যাব। হাতে হাতকড়া পড়বে। অরিত্রিকা, বাবা, মা! মুখ দেখাবে কীভাবে তাদের কাছে?
তারপর যেদিন মনসিজবাবু ব্রাঞ্চ মিটিংয়ে বললেন যে, ইনভেস্টিগেশন তিনি প্রায় গুটিয়ে এনেছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি সহকর্মীরা জানাতে পারবেন ডরম্যান্ট সব অ্যাকাউন্টের টাকা কে সরাচ্ছিল, কোথায় সরাচ্ছিল। সেদিন আর থাকতে পারেনি নীলার্ক। নিজের ঘরে এসে স্মার্টফোন খুলে টাইপ করেছিল, “সলভ মনসিজ সমাদ্দার প্রবলেম। মনসিজ সমাদ্দার নামক সমস্যার সমাধান চাই।”
কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়েছিল অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। তারপরেই ফোনের পরদায় ফুটে উঠেছিল উত্তর : "ডায়াবেটিস। চেঞ্জ ইনসুলিন স্ট্রেংথ। মনসিজবাবু মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। দু’বেলা নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয় তাঁকে। ধাঁ করে মনে পড়লো নীলার, আর্তির দেওয়া যে স্মার্টওয়াচটা সে কবজিতে বাঁধে, সেই স্মার্টওয়াচের সাদা রঙের স্ট্যাপটি তার ব্লাড শুগার, প্রেশার, হার্টবিট প্রতিমুহূর্তে মাপছে, আর স্মার্টফোনের সঙ্গে কম্পিউটার সংযোগে। বা ইন্টেলিজেন্ট লিঙ্ক-অ্যাপের মাধ্যমে তার স্মার্টফোনের কাছে চলে যাচ্ছে সেসব তথ্য। অরিত্রিকার হাতেও অনুরূপ স্মার্টওয়াচ। তার মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়িকেও ও জিনিস কিনে দিয়েছে নীলা। সবার স্বাস্থ্য তথ্যই এখন তার ফোনে। মাঝে-মাঝেই স্মার্টফোন অ্যাপ তাকে মনে করিয়ে দেয় নীলিমার । প্রেশারের ওষুধ কেনার কথা, বা বলে তার শ্বশুরের ব্লাড শুগার বেড়ে গিয়েছে। স্ট্রাপটা কীভাবে কাজ করে, সেটা বোঝাবার জন্য সে একদিন মনসিজবাবুকেও তার স্মার্টওয়াচটা পরিয়েছিল। মনসিজবাবু যে ডায়াবেটিক, সে তথ্য নিজের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে অ্যাপ!
সেই মুহূর্তে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। নীলার, অ্যাপ এর প্রস্তাব শুনে। কিন্তু পরদিন, এবং তারও পরের দিন, যতই ভেবেছে সে, বুঝেছে পরামর্শটির উপযোগিতা। শুধু একটা শিশি বদলে দেওয়া। নিজেই দু'বেলা ভায়াল থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে ইনসুলিন নেন। মনসিজবাবু। সবার অলক্ষ্যে একটা শিশি বদলে যদি তার চারগুণ শক্তির আর-একটা ইনসুলিনের শিশি রেখে দেওয়া যায়, কেউ বুঝতে পারবে না। এমনকি মনসিজবাবু নিজেও বুঝতে পারবেন না। কয়েকদিন ধরে ভাল করে লক্ষ্য করল নীলা। ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়, লাঞ্চ ব্রেক আগে যখন ইনসুলিন নেন মনসিজ বাবু, তখন কোনও একটা ফাইল নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকেছে নীলা। শিখেছে কাজের ব্যস্ততায় মনসিজবাবু ফাইল থেকে চোখ না। সরিয়েই অভ্যস্ত হতে ইনসুলিন টানছেন। ভয়াল থেকে, নিজের শরীরে সুচ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। অনায়াস দক্ষতায়। তাকিয়েও দেখছেন না।
ফলত কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল নীলার। মনসিজবাবু সেদিন ঘরে নেই, ডালহৌসি স্কোয়ারে হেড অফিসে গিয়েছেন। নীলার্ককে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে কেউ ফিরেও তাকাল না। স্প্রিং দেওয়া দরজা এমনিই বন্ধ হয়ে গেল তার পিছনে নীলার্ক জানে মনসিজবাবুর ওষুধ কোন ড্রয়ারে থাকে। বাঁদিকের প্রথম ড্রয়ারটা ক্ষিপ্র হাতে। খুলে ফেলল সে। যেহেতু রোজ ইনসুলিন নিতে হয় তাঁকে, মনসিজবাবু বেশ কয়েকটা ফাইল একসঙ্গে কিনে রাখেন। সলিউবল ইনসুলিনের একটা নতুন ফাইল সরিয়ে আর-একটা ফাইল রেখে দিল সেই জায়গায়। অবিকল একরকম দেখতে শিশির গায়ে সেই লেবেল খুটিয়ে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে মিলিলিটারে দশ ইউনিটের জায়গায় চল্লিশ
ইউনিটের একটা ওষুধ রাখা হল। দশ নেওয়ার কথা, তিনি চল্লিশ ইউনিট নিলে অবশ্যম্ভাবী প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে জ্ঞান হারানো, এবং দ্রুত চিকিৎসা হলে অবধারিত মৃত্যু। এবার শুধু অপেক্ষার পালা নীলা। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। ঘটল চার দিন পরেই।
বেশিরভাগ দিনই নিজের ঘরে বসে তাই সেদিন অনেকক্ষণ তাঁকে দেখা যায়নি, একথাটা খেয়ালই করেনি কেউ। বিকেল চারটের সময় বেয়ারা হীরালাল দিতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করে উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা অবস্থায়, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। ওয়েস্ট পেপার বিন থেকে সিরিঞ্জ আর ভায়াল বের করে দেখার কথা সময় মাথায়ই আসেনি কারও। পরের দিন যখন পুলিশ এসে ড্রয়ার খুলে ওষুধ দেখল, তখন তাে দেখা গেল সব ঠিকই আছে। আগের দিনের ওয়েস্ট বাস্কেট ততক্ষণে জঞ্জালশকটের গর্ভে।
এখন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট নিয়ে কোনও এনকোয়ারি করার প্রয়োজন নেই বলে উপরমহলে জানিয়েছে। মনসিজবাবুর মৃত্যুর একটা নামে মাত্র পুলিশ এনকোয়ারি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পুলিশ বলেছে। তাঁর অ্যাক্সিডেন্ট হাসপাতাল কোন কারণে আক্রান্ত হয়েছিলেন মনসিজবাবু। সংঘাতিক রোগে অতর্কিতে আক্রমণ করলে প্রতিকারের কোনও সময় দেয় না। অ্যাপটা এখন নীলার বন্ধু ভরসা করে উপর। মুহূর্তে অ্যাপের কথা শুনেই গাড়ি চালাচ্ছে আজও অ্যাপ তাকে সল্ট লেকের মধ্যে দিয়ে একটু ঘুরপথে নিয়ে যাচ্ছে। করে করুক। শুধু-শুধু চিন্তা করবে কেন? মল্লিকার্জুন মনসুরের ভৈরবটা বাজাচ্ছে অ্যাপ সেটা একেবারে অসামান্য। শুনতে-শুনতে বিভোর গিয়েছিল ফোন হঠাৎই যখন বলে উঠেছে, রাইট, টার্ন তখন চমকে সাত ভেবেই করে ডান দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছে সল্ট লেকে, শীতের সকালের কুয়াশা মাখা ফাঁকা রাস্তায়, উলটো দিক থেকে বিকট স্পিডে আসছিল লরিটা, তার চালক কোন পায়নি। চারচাকা আর সেই বিরাট ট্রাক এখন মোচড়ানো ইস্পাতের মণ্ড। কানফাটা আশপাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় লোক জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়ছে যত্রতত্র। বহুদুরে একটা ল্যাপটপ জেগে উঠেছে হঠাৎ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায়, মনোরম, ছোট শহর বেডফোর্ড। বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়-নগরী। ব্লুমিংটন থেকে খুব দূরে নয়। শহরের এক প্রান্তে বিরাট একটি হ্রদ। দিনের বেলা স্ফটিকের। মতো স্বচ্ছ জলে ঝকঝকে নীল আকাশের ছায়া। এখন প্রায় রাত সাড়ে ন'টা। হ্রদের জলে শহরের আলো পড়ে চিকচিক করছে। হ্রদের গায়ে এসে লুটিয়ে পড়েছে সবুজ পাহাড়ের ঢাল। প্রকৃতির সেই মনোরম কোণে ছবির মতো সব বাড়ি। বেডফোর্ড শহরের উচ্চবিত্ত উপকণ্ঠ এটি, এখানে প্রত্যেকটি বাড়িই চারদিকে লনে ঘেরা। হাল্কা নৈশাহার সেরে নরম সোফায় এলিয়ে বসে টেলিভিশনে খবর দেখছিল আর্তি। আর্তি দুমার হাতে ধুমায়িত কফির কাপ। রাতে খাওয়ার পর এক কাপ কফি হলে তার চলে না। এই শহরেই গত পাঁচবছর ধরে থাকে সে। এখানেই একটি আইটি সংস্থায় সে রিসার্চ বিভাগের প্রধান। দায়িত্বের চাকরি, বিরাট অংকের বেতন। কাল খুব সকালেই এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং আছে। তাই শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। আর্তি। শক্তিশালী ল্যাপটপ হঠাৎ জেগে উঠছে দেখে কোলের উপর টেনে নিল সেটিকে। কম্পিউটারের পরদায় একটি বার্তা সুঠাম, স্পষ্ট, ইংরেজি অক্ষরমালা"নীলা চ্যাটার্জি ইনভড ইন ফেটাল অ্যাক্সিডেন্ট। স্পট ডেড। কার-ট্রাক কলিশন, সল্ট লেক, ক্যালকাটা, ইনসিডেন্ট থ্রি মিনিটস আগো।"
স্তব্ধ হয়ে কোলের উপর রাখা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে আর্তি জানলার বাইরে। ফেব্রুয়ারি-রাত্রির তুষারপাত। রাতের অন্ধকারে সাদা হয়ে উঠেছে গাছপালা, মাঠঘাট, রাস্তা। কলকাতায় এখন সকাল আটটা। তিন মিনিট আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে নীলার্ক! আর্তির ল্যাপটপ তাই বলছে।
নীলার্ককে কেন বেছে নিয়েছিল সে? প্রতিহিংসা?
ভালবাসা? নাকি নিছকই পরিচিতির প্রশ্রয়? নীলার্কই তাদের কোম্পানির নতুন সফটওয়্যারের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়াস। টেস্ট রান এমন একটা স্মার্টফোন অ্যাপ তৈরি। করার দায়িত্ব ছিল তার টিমের যে অ্যাপ সবকিছু করতে পারে। সবকিছু করাতে পারে অ্যাপ। ফর এভরিথিং'। সফল পেশাদার হতে সাহায্য করবে অ্যাপ, সাহায্য করবে দারুণ প্রেমিক। 'হতে, করে তুলবে দায়িত্বশীল, সহমর্মী, স্বামী বা স্ত্রী। শুধু তাই নয়। এতই ক্ষমতাশালী হবে অ্যাপ
যে সে অনায়াস সাফল্য চুরি করতে পারবে, নিখুঁত দক্ষতায় খুন করাতে পারবে। করা হয়েছে নীলাকে। অ্যাপের প্রভাবে নীলাকে চাকরিতে উন্নতি করেছে, বিরাট বড়লোক হয়েছে, খুন করেও ধরা পড়েনি না -এমনকি সন্দেহের কোন আজও লাগেনি তার গায়ে। মাত্র পঞ্চাশটি অ্যাপ পরীক্ষামূলকভাবে ছেড়েছিল তারা। তাদের মধ্যে একজন লীলা। একবার অ্যাপটি কেউ ফোনে ডাউনলােড করে নিলে, অ্যাপকে আর তারা ইন্ডিয়ানার
অফিস থেকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নিজস্ব ছন্দে চলবে অ্যাপ। সখ্য গড়ে তুলবে। স্মার্টফোনের সঙ্গে। স্মার্টফোনের মালিকের সঙ্গে। তাকে নির্ভরশীল করে তুলবে নিজের উপর। সেভাবেই তারা তৈরি করেছিল এই শক্তিশালী। অ্যাপ! কিন্তু এত চূড়ান্ত রকমের শক্তিশালী? এত ভয়ঙ্কর তার পরিণতি?
গত কয়েক মাস ধরে তাদের অফিসের শক্তিশালী কম্পিউটারগুলি স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে লক্ষ্য, কিন্তু অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে নীলার্ককে। নীলার্ক তাদের নতুন অ্যাপের টেস্ট রান। তাই আরতি জানে কীভাবে নীলার্ক। একটু-একটু করে অ্যাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার অ্যাপ। খুন করাতে পারে তার অ্যাপ! কিন্তু খুন করতেও কী পারে? আজ সকালে কি অ্যাপটিকে উপক্ষা করে গাড়ি চালাচ্ছিল নীলার্ক ? নাকি অনুপুঙ্খ বাধ্যতায় অ্যাপ-এর নির্দেশ মেনে? এই মর্মান্তিক পরিণতির দায়িত্ব কার?
হঠাৎ কৈশোরে পড়া মহাভারত মনে পড়ল আর্তির। সৌপ্তিকপর্ব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের হাতে পর্যদস্ত হয়ে ক্রোধান্ধ অশ্বথামা।
মরিয়া হয়ে শেষ চাল চেলেছেন। অমোঘ ঈষীকাক্স পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে। নারদ এবং ব্যাসদেব অশ্বথামাকে বলছেন, "তুমি এই অক্ত প্রত্যাহার করে নাও, না হলে সভ্যতার বিনাশ হবে!” কিন্তু অশ্বত্থামা অস্ত্র ছাড়তে পারেন, একবার ছেড়ে দিলে তা প্রত্যাহার করতে পারেন। না! তখন তিনি অতি দীনমনে দ্বৈপায়নকে কহিলেন, “মুনিবর...আমি পৃথিবী পাণ্ডবশূন্য। করিব বলিয়া এই দুরাসদ দিব্যাস্ত্রে ব্রহ্মতেজ নিহিত করিয়া ইহা প্রয়োগ করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে ইহার প্রতিসংহারে সমর্থ হইতেছি না। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে এখনও বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর্তি। সারা শরীর স্থাণু হয়ে গিয়েছে। কফি ঠান্ডা জল। দশ হাজার মাইল দুরে সল্ট লেকের একটি রাস্তায় তখন একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করেছে। বাজার থেকে ফেরার পথে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখছেন বিকট দুর্ঘটনা। লরির চালকটি হাওয়া। দামি গাড়ির চালক স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরানোরও সময় পাননি। দোমড়ানো-মোচড়ানো ইস্পাতের মণ্ডের ভিতর দেখা যাচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া রক্তাক্ত মৃতদেহের উর্ধ্বাংশ। চোখের দৃষ্টি নিথর। মাথার একদিকটা নারকেলের খোলার মতো ফেটে গিয়ে রক্তমাখা নরম মাংসপিণ্ড ছিটকে গিয়েছে চারদিকে! এখন সকাল আটটা দশ। আজ একটু সকাল সকালই অফিস যাচ্ছিল নীলা।
তার পাশের সিটে রাখা স্মার্টফোনটা কিন্তু এখনও চালু। দুর্ঘটনার আগেই গাড়ির ব্যাটারি থেকে সে নিজের প্রাণদায়ী বিদ্যুৎ টেনে নিয়েছে।। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে যাচ্ছে ফুল চার্জ। নিঃশব্দ দক্ষতায় কাজ করেছে চলেছে অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। এখন সে নীলা্কর স্মার্টফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে ঢুকেছে। এক এক করে জমিয়ে রাখা নম্বরগুলিতে বার্তা পাঠাচ্ছে । “নীলার্ক চ্যাটার্জি ইনভড় ইন ফেটাল এক্সিডেন্ট দিস মিনিং ইন সল্ট লেক" -"আজ সকালে, লবণহ্রদে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। নীলা চ্যাটার্জির।”
"আরে! কী আশ্চর্য। তুই অ্যাপ ডাউনলোড করেছিস। সে মেয়েটাও কোন একটা কমপ্যাটিবল অ্যাপ ডাউনলোড করেছে, তা তাদের হরমোন লেভেল রিড করে দুটো অ্যাপ লিঙ্ক আপ করবে না? তা হলে অ্যাপ রেখে কী লাভ?"
“কিন্তু তা বলে, ওরকম মুহুর্তের মধ্যে,” এই মুহুর্তের মধ্যে না হলে কাজ হবে? অ্যাপ যদি একবছর লাগাত তাদের হরমোন ডেটা রিড করতে, দেখা হত তাদের? এটা অ্যালগরিদম-এর যুগ ব্রাদার। সবই আসলে অ্যালগরিদমের খেলা। এই যে তুই, আমি, এই কফির কাপটা, সবই আসলে এক-একটা অ্যালগরিদম। সবই শুধু ডেটা, শুধু তথ্য। এক একটা ক্ষেত্রে এক-একভাবে বিন্যস্ত ডেটা। এই তথ্য কে কীভাবে পড়তে পারছে, রিড করছে, প্রসেস করছে, তার উপর সবকিছু নির্ভর করে। যন্ত্র মানুষের থেকে অনেক গুণ তাড়াতাড়ি ডেটা রিড করে আর প্রসেস করে। এতে অবাক হচ্ছিস কেন?”
"আর আমার শ্বশুরের জন্মদিন? রোজ রাস্তা বলে দেওয়া?”
"এগুলো কোনও কথা হল? জন্মদিন সেভ করা থাকলে অ্যাপ অ্যালার্ট দেবে না তাকে? রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকলে স্যাটেলাইট ইমেজ স্ক্যান করে বলবে না? এগুলো তো বেসিক ব্যাপার। আরে গোরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ভুতের ওঝা, ঝাড়ফুঁকের যুগ তো আমরা পেরিয়ে এসেছি? নাকি? না, তুই খেয়াল করিস নি সেটা?”
কিন্তু এত সব সত্ত্বেও এর পরের দ্রুত-ঘটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না নীলার্ক কোনও একদিন তার অফিসের পিসি থেকে স্মার্টফোন চার্জ করেছিল সে। স্মার্টফোনের চার্জারটা অফিস কম্পিউটারের সিপিইউ তে ঢোকানোমাত্রই ফোন তাকে জিজ্ঞেস করে, “ট্রাস্ট দিস কম্পিউটার? আমি এই কম্পিউটারটিকে বিশ্বাস করতে পারি?” অফিসে, তার নিজের চেম্বারে বসানো কম্পিউটার। দ্বিরুক্তি না করে ইয়েস টিপে দিয়েছিল নীলার্ক। চার্জ শেষ হওয়ামাত্রই তার ফোন তাকে বলতে শুরু করে, ব্যাঙ্কে কোন কোন অ্যাকাউন্ট দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত, বা ডরম্যান্ট পড়ে আছে। সব ব্যাঙ্কেই কিছু-কিছু অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট, বা জীবন্মৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কেউ কখনও একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তারপর প্রযয়োজন ফুরিয়েছে, বা পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন, হয়তো বা শহর ছেড়েও, অথবা হয়ত মারাই গিয়েছেন কেউ, অ্যাকাউন্টটা আর বন্ধ করা হয়নি, ওভাবেই পড়ে আছে। কেউ টাকা তুলে বছরের পর বছর। টাকা ভরেও না। একের পর এক ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের সমস্ত খুঁটিনাটি ভেসে উঠতে আরম্ভ করেছে তার ফোনের পরদায় ।অ্যাকাউন্ট নম্বর, কতদিন ডরম্যান্ট আছে অ্যাকাউন্ট, কবে শেষ ব্যবহার হয়েছিল, কত টাকা আছে অ্যাকাউন্টে কিছু কিছু অ্যাকাউন্টে লক্ষ-লক্ষ টাকা ডরম্যান্ট হয়ে আছে। তার সঙ্গেই, মাঝে-মাঝে বলছে ফোন: “সেফ টু ট্রান্সফার ফ্রম দিস অ্যাকাউন্ট। স্টার্ট ট্রান্সফার?” অর্থাৎ এই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানো নিরাপদ। সরিয়ে ফেলব?
লোভ? কৌতূহল? কেন করেছিল জানে না নীলার্ক, কিন্তু পরপর কয়েকদিন ফোনের পরদায় এই প্রশ্ন দেখার পর একদিন হঠাৎ ইয়েস টিপে দিয়েছিল। বত্রিশ লাখ টাকার একটা ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট খালি করে তার অ্যাকাউন্টে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার স্মার্টফোন অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। সবকিছুর অ্যাপ। তারপর আরও দু'বার ঘটেছিল সেই ঘটনা। একবার পনেরো লক্ষ টাকা। একবার চব্বিশ লাখ।
সে তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।। ব্যাপারটা ঠিক কী ভাবে হল, সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মনসিজ সমাদ্দার। তা আজও জানে না নীলার্ক। দ্রুত একটা ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছিলেন তিনি। নীলার্কর তখন দিশেহারা অবস্থা। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় ধরা পড়ে যাব। হাতে হাতকড়া পড়বে। অরিত্রিকা, বাবা, মা! মুখ দেখাবে কীভাবে তাদের কাছে?
তারপর যেদিন মনসিজবাবু ব্রাঞ্চ মিটিংয়ে বললেন যে, ইনভেস্টিগেশন তিনি প্রায় গুটিয়ে এনেছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি সহকর্মীরা জানাতে পারবেন ডরম্যান্ট সব অ্যাকাউন্টের টাকা কে সরাচ্ছিল, কোথায় সরাচ্ছিল। সেদিন আর থাকতে পারেনি নীলার্ক। নিজের ঘরে এসে স্মার্টফোন খুলে টাইপ করেছিল, “সলভ মনসিজ সমাদ্দার প্রবলেম। মনসিজ সমাদ্দার নামক সমস্যার সমাধান চাই।”
কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়েছিল অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। তারপরেই ফোনের পরদায় ফুটে উঠেছিল উত্তর : "ডায়াবেটিস। চেঞ্জ ইনসুলিন স্ট্রেংথ। মনসিজবাবু মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। দু’বেলা নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয় তাঁকে। ধাঁ করে মনে পড়লো নীলার, আর্তির দেওয়া যে স্মার্টওয়াচটা সে কবজিতে বাঁধে, সেই স্মার্টওয়াচের সাদা রঙের স্ট্যাপটি তার ব্লাড শুগার, প্রেশার, হার্টবিট প্রতিমুহূর্তে মাপছে, আর স্মার্টফোনের সঙ্গে কম্পিউটার সংযোগে। বা ইন্টেলিজেন্ট লিঙ্ক-অ্যাপের মাধ্যমে তার স্মার্টফোনের কাছে চলে যাচ্ছে সেসব তথ্য। অরিত্রিকার হাতেও অনুরূপ স্মার্টওয়াচ। তার মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়িকেও ও জিনিস কিনে দিয়েছে নীলা। সবার স্বাস্থ্য তথ্যই এখন তার ফোনে। মাঝে-মাঝেই স্মার্টফোন অ্যাপ তাকে মনে করিয়ে দেয় নীলিমার । প্রেশারের ওষুধ কেনার কথা, বা বলে তার শ্বশুরের ব্লাড শুগার বেড়ে গিয়েছে। স্ট্রাপটা কীভাবে কাজ করে, সেটা বোঝাবার জন্য সে একদিন মনসিজবাবুকেও তার স্মার্টওয়াচটা পরিয়েছিল। মনসিজবাবু যে ডায়াবেটিক, সে তথ্য নিজের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে অ্যাপ!
সেই মুহূর্তে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। নীলার, অ্যাপ এর প্রস্তাব শুনে। কিন্তু পরদিন, এবং তারও পরের দিন, যতই ভেবেছে সে, বুঝেছে পরামর্শটির উপযোগিতা। শুধু একটা শিশি বদলে দেওয়া। নিজেই দু'বেলা ভায়াল থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে ইনসুলিন নেন। মনসিজবাবু। সবার অলক্ষ্যে একটা শিশি বদলে যদি তার চারগুণ শক্তির আর-একটা ইনসুলিনের শিশি রেখে দেওয়া যায়, কেউ বুঝতে পারবে না। এমনকি মনসিজবাবু নিজেও বুঝতে পারবেন না। কয়েকদিন ধরে ভাল করে লক্ষ্য করল নীলা। ঠিক দুপুর সাড়ে বারোটায়, লাঞ্চ ব্রেক আগে যখন ইনসুলিন নেন মনসিজ বাবু, তখন কোনও একটা ফাইল নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকেছে নীলা। শিখেছে কাজের ব্যস্ততায় মনসিজবাবু ফাইল থেকে চোখ না। সরিয়েই অভ্যস্ত হতে ইনসুলিন টানছেন। ভয়াল থেকে, নিজের শরীরে সুচ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। অনায়াস দক্ষতায়। তাকিয়েও দেখছেন না।
ফলত কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল নীলার। মনসিজবাবু সেদিন ঘরে নেই, ডালহৌসি স্কোয়ারে হেড অফিসে গিয়েছেন। নীলার্ককে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে কেউ ফিরেও তাকাল না। স্প্রিং দেওয়া দরজা এমনিই বন্ধ হয়ে গেল তার পিছনে নীলার্ক জানে মনসিজবাবুর ওষুধ কোন ড্রয়ারে থাকে। বাঁদিকের প্রথম ড্রয়ারটা ক্ষিপ্র হাতে। খুলে ফেলল সে। যেহেতু রোজ ইনসুলিন নিতে হয় তাঁকে, মনসিজবাবু বেশ কয়েকটা ফাইল একসঙ্গে কিনে রাখেন। সলিউবল ইনসুলিনের একটা নতুন ফাইল সরিয়ে আর-একটা ফাইল রেখে দিল সেই জায়গায়। অবিকল একরকম দেখতে শিশির গায়ে সেই লেবেল খুটিয়ে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে মিলিলিটারে দশ ইউনিটের জায়গায় চল্লিশ
ইউনিটের একটা ওষুধ রাখা হল। দশ নেওয়ার কথা, তিনি চল্লিশ ইউনিট নিলে অবশ্যম্ভাবী প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে জ্ঞান হারানো, এবং দ্রুত চিকিৎসা হলে অবধারিত মৃত্যু। এবার শুধু অপেক্ষার পালা নীলা। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। ঘটল চার দিন পরেই।
বেশিরভাগ দিনই নিজের ঘরে বসে তাই সেদিন অনেকক্ষণ তাঁকে দেখা যায়নি, একথাটা খেয়ালই করেনি কেউ। বিকেল চারটের সময় বেয়ারা হীরালাল দিতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করে উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা অবস্থায়, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। ওয়েস্ট পেপার বিন থেকে সিরিঞ্জ আর ভায়াল বের করে দেখার কথা সময় মাথায়ই আসেনি কারও। পরের দিন যখন পুলিশ এসে ড্রয়ার খুলে ওষুধ দেখল, তখন তাে দেখা গেল সব ঠিকই আছে। আগের দিনের ওয়েস্ট বাস্কেট ততক্ষণে জঞ্জালশকটের গর্ভে।
এখন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট নিয়ে কোনও এনকোয়ারি করার প্রয়োজন নেই বলে উপরমহলে জানিয়েছে। মনসিজবাবুর মৃত্যুর একটা নামে মাত্র পুলিশ এনকোয়ারি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পুলিশ বলেছে। তাঁর অ্যাক্সিডেন্ট হাসপাতাল কোন কারণে আক্রান্ত হয়েছিলেন মনসিজবাবু। সংঘাতিক রোগে অতর্কিতে আক্রমণ করলে প্রতিকারের কোনও সময় দেয় না। অ্যাপটা এখন নীলার বন্ধু ভরসা করে উপর। মুহূর্তে অ্যাপের কথা শুনেই গাড়ি চালাচ্ছে আজও অ্যাপ তাকে সল্ট লেকের মধ্যে দিয়ে একটু ঘুরপথে নিয়ে যাচ্ছে। করে করুক। শুধু-শুধু চিন্তা করবে কেন? মল্লিকার্জুন মনসুরের ভৈরবটা বাজাচ্ছে অ্যাপ সেটা একেবারে অসামান্য। শুনতে-শুনতে বিভোর গিয়েছিল ফোন হঠাৎই যখন বলে উঠেছে, রাইট, টার্ন তখন চমকে সাত ভেবেই করে ডান দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছে সল্ট লেকে, শীতের সকালের কুয়াশা মাখা ফাঁকা রাস্তায়, উলটো দিক থেকে বিকট স্পিডে আসছিল লরিটা, তার চালক কোন পায়নি। চারচাকা আর সেই বিরাট ট্রাক এখন মোচড়ানো ইস্পাতের মণ্ড। কানফাটা আশপাশের বাড়িগুলোর বারান্দায় লোক জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়ছে যত্রতত্র। বহুদুরে একটা ল্যাপটপ জেগে উঠেছে হঠাৎ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায়, মনোরম, ছোট শহর বেডফোর্ড। বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়-নগরী। ব্লুমিংটন থেকে খুব দূরে নয়। শহরের এক প্রান্তে বিরাট একটি হ্রদ। দিনের বেলা স্ফটিকের। মতো স্বচ্ছ জলে ঝকঝকে নীল আকাশের ছায়া। এখন প্রায় রাত সাড়ে ন'টা। হ্রদের জলে শহরের আলো পড়ে চিকচিক করছে। হ্রদের গায়ে এসে লুটিয়ে পড়েছে সবুজ পাহাড়ের ঢাল। প্রকৃতির সেই মনোরম কোণে ছবির মতো সব বাড়ি। বেডফোর্ড শহরের উচ্চবিত্ত উপকণ্ঠ এটি, এখানে প্রত্যেকটি বাড়িই চারদিকে লনে ঘেরা। হাল্কা নৈশাহার সেরে নরম সোফায় এলিয়ে বসে টেলিভিশনে খবর দেখছিল আর্তি। আর্তি দুমার হাতে ধুমায়িত কফির কাপ। রাতে খাওয়ার পর এক কাপ কফি হলে তার চলে না। এই শহরেই গত পাঁচবছর ধরে থাকে সে। এখানেই একটি আইটি সংস্থায় সে রিসার্চ বিভাগের প্রধান। দায়িত্বের চাকরি, বিরাট অংকের বেতন। কাল খুব সকালেই এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং আছে। তাই শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। আর্তি। শক্তিশালী ল্যাপটপ হঠাৎ জেগে উঠছে দেখে কোলের উপর টেনে নিল সেটিকে। কম্পিউটারের পরদায় একটি বার্তা সুঠাম, স্পষ্ট, ইংরেজি অক্ষরমালা"নীলা চ্যাটার্জি ইনভড ইন ফেটাল অ্যাক্সিডেন্ট। স্পট ডেড। কার-ট্রাক কলিশন, সল্ট লেক, ক্যালকাটা, ইনসিডেন্ট থ্রি মিনিটস আগো।"
স্তব্ধ হয়ে কোলের উপর রাখা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে আর্তি জানলার বাইরে। ফেব্রুয়ারি-রাত্রির তুষারপাত। রাতের অন্ধকারে সাদা হয়ে উঠেছে গাছপালা, মাঠঘাট, রাস্তা। কলকাতায় এখন সকাল আটটা। তিন মিনিট আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে নীলার্ক! আর্তির ল্যাপটপ তাই বলছে।
নীলার্ককে কেন বেছে নিয়েছিল সে? প্রতিহিংসা?
ভালবাসা? নাকি নিছকই পরিচিতির প্রশ্রয়? নীলার্কই তাদের কোম্পানির নতুন সফটওয়্যারের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়াস। টেস্ট রান এমন একটা স্মার্টফোন অ্যাপ তৈরি। করার দায়িত্ব ছিল তার টিমের যে অ্যাপ সবকিছু করতে পারে। সবকিছু করাতে পারে অ্যাপ। ফর এভরিথিং'। সফল পেশাদার হতে সাহায্য করবে অ্যাপ, সাহায্য করবে দারুণ প্রেমিক। 'হতে, করে তুলবে দায়িত্বশীল, সহমর্মী, স্বামী বা স্ত্রী। শুধু তাই নয়। এতই ক্ষমতাশালী হবে অ্যাপ
যে সে অনায়াস সাফল্য চুরি করতে পারবে, নিখুঁত দক্ষতায় খুন করাতে পারবে। করা হয়েছে নীলাকে। অ্যাপের প্রভাবে নীলাকে চাকরিতে উন্নতি করেছে, বিরাট বড়লোক হয়েছে, খুন করেও ধরা পড়েনি না -এমনকি সন্দেহের কোন আজও লাগেনি তার গায়ে। মাত্র পঞ্চাশটি অ্যাপ পরীক্ষামূলকভাবে ছেড়েছিল তারা। তাদের মধ্যে একজন লীলা। একবার অ্যাপটি কেউ ফোনে ডাউনলােড করে নিলে, অ্যাপকে আর তারা ইন্ডিয়ানার
অফিস থেকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নিজস্ব ছন্দে চলবে অ্যাপ। সখ্য গড়ে তুলবে। স্মার্টফোনের সঙ্গে। স্মার্টফোনের মালিকের সঙ্গে। তাকে নির্ভরশীল করে তুলবে নিজের উপর। সেভাবেই তারা তৈরি করেছিল এই শক্তিশালী। অ্যাপ! কিন্তু এত চূড়ান্ত রকমের শক্তিশালী? এত ভয়ঙ্কর তার পরিণতি?
গত কয়েক মাস ধরে তাদের অফিসের শক্তিশালী কম্পিউটারগুলি স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে লক্ষ্য, কিন্তু অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে নীলার্ককে। নীলার্ক তাদের নতুন অ্যাপের টেস্ট রান। তাই আরতি জানে কীভাবে নীলার্ক। একটু-একটু করে অ্যাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার অ্যাপ। খুন করাতে পারে তার অ্যাপ! কিন্তু খুন করতেও কী পারে? আজ সকালে কি অ্যাপটিকে উপক্ষা করে গাড়ি চালাচ্ছিল নীলার্ক ? নাকি অনুপুঙ্খ বাধ্যতায় অ্যাপ-এর নির্দেশ মেনে? এই মর্মান্তিক পরিণতির দায়িত্ব কার?
হঠাৎ কৈশোরে পড়া মহাভারত মনে পড়ল আর্তির। সৌপ্তিকপর্ব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের হাতে পর্যদস্ত হয়ে ক্রোধান্ধ অশ্বথামা।
মরিয়া হয়ে শেষ চাল চেলেছেন। অমোঘ ঈষীকাক্স পৃথিবী ধ্বংস করে দেবে। নারদ এবং ব্যাসদেব অশ্বথামাকে বলছেন, "তুমি এই অক্ত প্রত্যাহার করে নাও, না হলে সভ্যতার বিনাশ হবে!” কিন্তু অশ্বত্থামা অস্ত্র ছাড়তে পারেন, একবার ছেড়ে দিলে তা প্রত্যাহার করতে পারেন। না! তখন তিনি অতি দীনমনে দ্বৈপায়নকে কহিলেন, “মুনিবর...আমি পৃথিবী পাণ্ডবশূন্য। করিব বলিয়া এই দুরাসদ দিব্যাস্ত্রে ব্রহ্মতেজ নিহিত করিয়া ইহা প্রয়োগ করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে ইহার প্রতিসংহারে সমর্থ হইতেছি না। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে এখনও বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর্তি। সারা শরীর স্থাণু হয়ে গিয়েছে। কফি ঠান্ডা জল। দশ হাজার মাইল দুরে সল্ট লেকের একটি রাস্তায় তখন একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করেছে। বাজার থেকে ফেরার পথে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখছেন বিকট দুর্ঘটনা। লরির চালকটি হাওয়া। দামি গাড়ির চালক স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরানোরও সময় পাননি। দোমড়ানো-মোচড়ানো ইস্পাতের মণ্ডের ভিতর দেখা যাচ্ছে স্টিয়ারিংয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া রক্তাক্ত মৃতদেহের উর্ধ্বাংশ। চোখের দৃষ্টি নিথর। মাথার একদিকটা নারকেলের খোলার মতো ফেটে গিয়ে রক্তমাখা নরম মাংসপিণ্ড ছিটকে গিয়েছে চারদিকে! এখন সকাল আটটা দশ। আজ একটু সকাল সকালই অফিস যাচ্ছিল নীলা।
তার পাশের সিটে রাখা স্মার্টফোনটা কিন্তু এখনও চালু। দুর্ঘটনার আগেই গাড়ির ব্যাটারি থেকে সে নিজের প্রাণদায়ী বিদ্যুৎ টেনে নিয়েছে।। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে যাচ্ছে ফুল চার্জ। নিঃশব্দ দক্ষতায় কাজ করেছে চলেছে অ্যাপ। অ্যাপ ফর এভরিথিং। এখন সে নীলা্কর স্মার্টফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে ঢুকেছে। এক এক করে জমিয়ে রাখা নম্বরগুলিতে বার্তা পাঠাচ্ছে । “নীলার্ক চ্যাটার্জি ইনভড় ইন ফেটাল এক্সিডেন্ট দিস মিনিং ইন সল্ট লেক" -"আজ সকালে, লবণহ্রদে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। নীলা চ্যাটার্জির।”
সল্ট লেক, গন্ক গ্রিন, আহিরীটোলা, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ – উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতার নানা প্রান্তে, সকালের নানাবিধ ব্যস্ততার মাঝে, বিভিন্ন মানুষ টের পাচ্ছেন হাতের মুঠোয় ধরা, ব্যাগে ভিতরে রাখা, পকেটে সযত্নে রক্ষিত মোবাইল ফোনের স্পন্দন ।
ーーーーーーーーーーー