ছোট গল্প
রঙ
সেই কোন ছেলেবেলা থেকে রঙের সঙ্গে বড়ো বিবাদ তিলোত্তমার । যখন তার দুবছর বয়স তখন সে তার মা কে হারায় । তাই মাকে সেভাবে মনেও পড়ে না ,খুব আবছা মায়ের ধূসর কিছু স্মৃতি মনে আছে তিলোত্তমার ।ছোট থেকেই আঁকা ও রঙের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল তিলোত্তমার ।ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে সাদা কাগজের ওপর সুন্দর আঁকত সে ।কিন্তু একদিন ওর বাবার খুব প্রিয় সাদা রঙের একটা শার্টের ওপর তিলোত্তমার হাত থেকে রঙ পড়ে যাওয়ার শাস্তি হিসেবে তার সমস্ত রঙ এবং আঁকার সরঞ্জামের জায়গা হয় বাড়ির বাইরে আবর্জনার স্তুপে ।আঁকা ও রঙের সখ সেদিনের পর ঘুচে যায় তার ।তিলোত্তমার ছোট্ট মন বুঝতেও পারেনি সেদিন তার পাওয়া এরকম শাস্তির কারণ ? রঙের সাথে সেদিনই শুরু তার প্রথম আড়ির পালা ।
এরপর একটু বড় হবার পর তিলোত্তমা তার ঠাম্মার কাছে জেনেছিল বড্ড ভালোবাসত বাবা ওর মা কে ।
তিলোত্তমার জন্মের সময় থেকেই ওর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে । এরপর টানা দুবছর ট্রিটমেন্ট চলার পর তার মা মারা যায় ।মায়ের এই অকাল মৃত্যুটা ওর বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ।
তার বাবার ঐ সাদা শার্ট টা তার মায়ের দেওয়া উপহার ছিল তাই ওটার মূল্য নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি ছিল সেদিন তার বাবার
কাছে , এটা বুঝতে পেরেছিল তিলোত্তমা ।
তবে তিলোত্তমা নিজেই যে বাবাকে দেওয়া তার মায়ের শ্রেষ্ঠ উপহার সেটা তার বাবা কেন কোনও দিন বোঝেনি ,কেন তার মায়ের মৃত্যুর জন্য তাকেই পরোক্ষে দায়ী করে এসেছে, কেন তাকে সন্তান স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছে?
নিজের কাছে নিজেই এই প্রশ্ন টা সে করে এসেছে চিরকাল ।
এরপর তিলোত্তমা যখন ষোলো বছর তখন তার কোচিং ক্লাসের একধারে বসে থাকা চুপচাপ ছেলেটি কে বড় মনে ধরে তার । তিলোত্তমার দুচোখ জুড়ে শুধু সেই ছেলে টার স্বপ্ন ।প্রেমের রঙে রঙিন তখন তার অন্তর বাহির সর্বত্র। কিন্তু তিলোত্তমার জীবনে সেই প্রেমের রঙও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি ।একদিন কোচিং ক্লাসে গিয়ে সে হঠাত্ জানতে পারে ঐ ছেলেটির বাবা বদলি হয়ে সপরিবারে অন্য শহরে চলে গেছে ।একতরফা প্রেমের সেদিনই ইতি । তিলোত্তমার হৃদয়ে লাগা প্রেমের রঙ তার চোখের জলে ধুয়ে যায় পুরোপুরি ।
এর কয়েকবছর পর বাবার দেখা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় তিলোত্তমার ।বড়লোক শ্বশুর বাড়ি, স্বামী, সংসার এসব কিছু নিয়ে ভীষণ সুখী তখন তিলোত্তমা ।তার চোখে তখন অনেক রঙিন স্বপ্ন আগামী দিনের ।স্বামীর ভালোবাসা ও আদরে তৃপ্ত সে ।বিয়ের একবছরের মধ্যে তিলোত্তমার কোল আলো করে আসে তাদের সন্তান রক্তিম ।
কিন্তু কে জানত তিলোত্তমার ভাগ্য এভাবে পাল্টে দেবে তার দেখা সমস্ত স্বপ্ন কে ।ভেঙে খানখান হয়ে যাবে তার সাজানো সংসার । এমনভাবে জীবনের সব রঙ মুছে গিয়ে বর্ণহীন হয়ে যাবে সে ।অফিস ফিরতি পথে একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তিলোত্তমার স্বামীর ।এরপর পুরোপুরি বদলে যায় তার ও ছোট্ট রক্তিমের জীবন ।শ্বশুর বাড়িতে দিনের পর দিন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে যায় সে, ছেলেকে নিয়ে ।নিজের বাবার কাছেও আর ফিরে গিয়ে তার বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি তিলোত্তমা ।
সেই শুরু তার ঐ একরত্তি ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রানপন লড়াই ।
রক্তিমের যখন চার বছর বয়স তখন একবার খুব অসুস্থ হয় সে ।পাড়ার ডাক্তারবাবু তো প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন ।টাকার অভাবে ছেলে টাকেই হারাতে বসেছিল তিলোত্তমা ।কিন্তু ভগবানের আশীর্বাদ হয়ে সেদিন এসেছিল ডঃ অভিরূপ মুখোপাধ্যায় ওদের জীবনে ।অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে যখন তিলোত্তমা ছুটে গিয়েছিল শহরের সবচেয়ে বড় চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডঃ অভিরূপ মুখোপাধ্যায় এর কাছে তখন প্রায় বিনা পয়সায় চিকিত্সা করে ছিলেন উনি রক্তিমের ।বলা যেতে পারে তিলোত্তমার জীবনের অবলম্বন কে ওর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন উনি ।
সেই পরিচয় তিলোত্তমার অভিরূপের সাথে ।
আজ কুড়ি বছর ধরে দুজনে খুব ভালো বন্ধু ।জীবনে কোনও দিনই সংসারী হতে চায়নি অভিরূপ ।নিজের হসপিটাল, চেম্বার এইসব নিয়ে আর শহরের বেশ কিছু এন জি ওর সঙ্গে যুক্ত উনি ।আর অবসর সময়ে তার একমাত্র সঙ্গী রঙ আর তুলি ।
তার আঁকা ছবি যেন কথা বলে ।
তাছাড়া এমন অমায়িক, ভদ্র মানুষ খুব কম দেখেছে তিলোত্তমা তার জীবনে । যেকোনো বিপদে আপদে সে সবসময় এই অভিরূপ কে নিজের বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছে ।সে তিলোত্তমার এন জি ও তে চাকরি করে দেওয়াই হোক কিংবা রক্তিমের স্কুলে ভর্তির সময়ই হোক ।
এখন তিলোত্তমা পঞ্চাশ ।চুলে পাক ধরেছে চোখে উঠেছে চশমা ।রক্তিম কে বড় করতে প্রতিষ্ঠিত করতে কেটে গেছে জীবনের অনেকটা সময় ।নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়নি সেভাবে কোনও দিন তার ।তিলোত্তমার পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে একটা ছোট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রক্তিম ।ওর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন, কিছু চেনা পরিচিত আর অভিরূপ নিমন্ত্রিত ।
অভিরূপ আজ উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছে তার আঁকা তিলোত্তমার একটা ছবি ।সেই ছবিতে তিলোত্তমা রঙিন ।তার কপালে লাল টিপ, চোখে
কাজলের ছোঁয়া, পরনে রঙিন শাড়ি ।
যে তিলোত্তমা একদিন হারিয়ে গেছিল জীবনের অজানা পথে আজ আবার সেই তিলোত্তমা কে নিজের তুলির টানে ফিরিয়ে এনেছে অভিরূপ ।
অভিরূপ চায় ঠিক এমন ভাবেই তিলোত্তমা আসুক তার জীবনে ।তবে সবটাই তিলোত্তমার সিদ্ধান্ত ।অভিরূপ শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেটুকু জানিয়েছে তাকে ।অনেক বছর লেগেছে অভিরূপের নিজের মনের কথা তিলোত্তমা কে জানাতে ।হয়তো একটু বেশি দেরি করে ফেলেছে সে ।চৌত্রিশ বছর আগে তাদের কোচিং ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার ,সেই কালো চোখের চাউনি কোনও দিন ভুলতে পারেনি
অভিরূপ ।সে নিজেও যে খুব পছন্দ করত তিলোত্তমা কে ।কিন্তু সেদিন নিজের মনের কথা মনে রেখেই পরিবারের সঙ্গে অন্য শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল সে ।আজও মনে আছে অভিরূপের সেই দিনটার কথা যেদিন তিলোত্তমা ,নিজের মুমূর্ষু ছেলেকে বাঁচানোর জন্য ছুটে এসেছিল তার কাছে । তখন তিলোত্তমার চোখে অভিরূপ দেখেছিল শুধুমাত্র মা হিসেবে নিজের সন্তান কে হারিয়ে ফেলার ভয় আর সেই কালো চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল সন্তানের জন্য এক মায়ের হাহাকার ।তিলোত্তমার তখন একটাই পরিচয় সে রক্তিমের মা ।অভিরূপ কে সেদিন চিনতে পারলেও, জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত তিলোত্তমার মনে অভিরূপের প্রতি আর কোনও অনুভূতি যে অবশিষ্ট ছিলনা সেটা উপলব্ধি করেছিল অভিরূপ নিজে ।
" মা সই টা কর " বলে উঠল
রক্তিম ।রেজিস্ট্রার এর দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় সই করল তিলোত্তমা ও অভিরূপ ।তাদের বিয়ের সাক্ষী হিসেবে সই করল রক্তিম ।তিলোত্তমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অভিরূপের সব কথা শোনার পর এই বিয়ের সিদ্ধান্ত টা খুব সহজ ছিলনা তিলোত্তমার কাছে ।রক্তিম সমাজ সংস্কার এসব কিছুর পরোয়া না করে অভিরূপ কে সমর্থন
করেছিল সর্বত ভাবে ।উপস্থিত সবাই সবকিছু জানবার পর কিছুক্ষণ চলেছিল সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ।বিধবার আবার বিয়ে? ছুটে এসেছিল এমনই সব প্রশ্নের তীর তাদের দিকে ।
তবে সেদিন রক্তিম সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে অভিরূপকে সবার সামনে মন থেকে নিজের বাবার স্বীকৃতি দিয়েছিল ।সবাই কে বলেছিল
"আমাদের কাছে মা আদর্শ ধৈর্য্য, সহনশীলতার প্রতীক ।কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমাদের মা রাও একজন রক্ত মাংসে গড়া সাধারণ মানুষ ।তাদের ও মন থাকে , মতামত থাকে কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে ।
তিলোত্তমা ওকে অনেক কষ্ট করে যোগ্য মানুষ তৈরি করেছে । তাকে মানুষ করতে গিয়ে কখনও নিজের সুখের কথা ভাবেনি, নিজের কথা ভাবেনি ।একবারের জন্যও বাবার অনুপস্থিতি তাকে বুঝতে দেয়নি ।এবার রক্তিমের সময় এসেছে নিজের মায়ের জন্য কিছু করবার ,
তাই আজ সে তার মাকে তার প্রাপ্য খুশিটুকু ফিরিয়ে দিতে চায় ।তার মায়ের জীবনের বাকি দিনগুলো সুন্দর হোক এটাই সে চায় ।আর নিজের মায়ের সুখের জন্য সে সবকিছু করতে পারে" ।
নিজের সন্তান কে সেদিন দৃঢ়ভাবে এই কথাগুলো বলতে দেখে নিজের চোখের জল বাঁধ মানেনি তিলোত্তমার । সেদিন সত্যি তিলোত্তমার মনে হয়েছিল, সে পেরেছে তার সন্তান কে যথার্থ মানুষ তৈরি করতে ।
বিয়ের পর আজ সুখী দম্পতি তিলোত্তমা অভিরূপ ।
আজ আর তিলোত্তমার রঙের সঙ্গে কোনও বিবাদ নেই ।এক এক করে জীবনের সব রঙ ফিরে পেয়েছে সে ।
সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে লাল টিপ, দু হাতে শাঁখা পলা ,পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি ।
তিলোত্তমার রঙহীন জীবনকে অভিরূপ তার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে তুলেছে ।স্বামী, সন্তান নিয়ে সম্পূর্ণভাবে আজ পরিপূর্ণ তিলোত্তমা ।।
________________