নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি কবিতা সমগ্র
আন্ধকারে, একলা মানুষ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
ঠাট্টা, হাসি,
গান,
কলরব
যেই থেমেছে,
দূরে
কাছে
দেখছি পথের
সঙ্গীরা সব
স্তব্ধ হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে।
ব্যাপার কী,
আর
গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে
অনেক বাকি।
চোখ তুলে
কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব
কথা কি?
সত্যি ছিল
সঙ্গীরা? ধুস্।
মধ্যরাতে পথের
ধারে
এই তো আমি একলা
মানুষ
দাঁড়িয়ে
আছি অন্ধকারে।
ーーーーーーーーーーーーーーー
অন্ত্য রঙ্গ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
হারে-রে রঙ্গিলা,
তোর
কথার টানে টানে
পাগল হয়ে ঘুরে
বেড়াই, সমস্ত রাতভোর
কোন্ কামনার
আগুন ছুঁয়ে স্বপ্ন দেখি তোর,
কোন্ দুরাশার,
রঙ্গিলা?
তুই
হঠাৎ কোনোখানে
না ভাঙলে
না-দেখার দেয়াল, মিথ্যে এ তোর খোঁজে
দিন কাটানোল
বাঁধন খোলার স্বপ্নে দিয়ে ছাই
ঘর ছাড়িয়ে পরিয়ে
দিলি পথের বাঁধন,
তাই ব্যর্থ হল
রঙ্গিলা তোর সমস্ত রঙ্গ যে।
হারে-রে রঙ্গিলা,
তোর
গানের টানে টানে
পার হয়েছি দুঃখ,
তবু
কেমন করে ভুলি
আজও আমার জীর্ণ
শাখায় সুখের কুঁড়িগুলি
পাপড়ি মেলে
দেয়নি, আমার শুকনো মরা গাঙে
তরঙ্গ নেই,
হৃদয়ধনুর
দৃপ্ত কঠিন ছিলা
দিনে দিনে শিথিল
হল; রঙ্গিলা, এইবার
অন্ধকারকে ছিন্ন
করে ফুলের মন্ত্র আর
ঢেউয়ের মন্ত্র
শেখা আমায়, রঙ্গিলা রঙ্গিলা!
হারে-রে রঙ্গিলা,
তোর
সময় নিরবধি
রঙ্গও অনন্ত,
আমার
সময় নেই যে আর,
কে আমাকে শিখিয়ে
দেবে পথের হাহাকার
কী করে হয় শান্ত,
আমার
প্রাণের শুকনো নদী
উজান বইবে কেমন
করে, অমর্ত্য কোন্ গানে
ফুল ফুটিয়ে
ব্যর্থ করি শীতের তাড়নায়,–
তুই যদি না
শেখাস তবে চলব না আর, না,
রঙ্গিলা
তোর কথার টানে, টানের টানে টানে।
ーーーーーーーーーーーーーー
আমর্ত্য গান
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
সাধারণ, তুমি
সাধারণ, তাই
অসাধারণের গানে
উতলা হয়ো না
হয়ো না, তোমার
যা কিছু স্বপ্ন
সীমা টানো তার,
তুলে দাও খিল
হৃদয়ে, নিখিল
বসুধার সন্ধানে
যেয়ো না,
তোমার
নেই অধিকার
দুর্লভ তার
গানে।
সাধারণ, তুমি
সাধারণ, তাই
ছোট আশা
ভালবাসা—
তা-ই দিয়ে ছোট
হৃদয় ভরাও,
তার বেশি যদি
কিছু পেতে চাও
পাবে না,
পাবে
না, যাকে আজও চেনা
হল না, সর্বনাশা
সেই মায়াবীর
গান ভুলে যাও,
ভুলো তার
ভালবাসা।
সাধারণ, তুমি
সাধারণ, তবু
অসাধারণের গানে
ভুলেছ; পুড়েছে
ছোট ছোট আশা,
পুড়েছে তোমার
ছোট ভালবাসা,
ছোট হাসি আর ছোট
কান্নার
সব স্মৃতি সেই
প্রাণে
বুঝি মুছে যায়
যে-প্রাণ হারায়
সেই
অমর্ত্য গানে।
ーーーーーーーーーーーー
ーーーーーーーーーーーー
আমানুষ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
শিম্পাঞ্জি,
তোমাকে
আজ বড় বেশি বিমর্ষ দেখলুম
চিড়িয়াখানায়।
তুমি ঝিলের কিনারে।
দারুণ
দুঃখিতভাবে বসে ছিলে। তুমি
একবারও উঠলে না
এসে লোহার দোলনায়;
চাঁপাকলা,
বাদাম,
কাবলি-ছোলা–সবকিছু
উপেক্ষিত ছড়ানো
রইল। তুমি ফিরেও দেখলে না।
দুঃখী মানুষের
মতো হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজে
ঝিলের কিনারে
শুধু বসে রইলে একা।
শিম্পাঞ্জি,
তোমাকে
কেন এত বেশি বিমর্ষ দেখলুম?
কী দুঃখ তোমার?
তুমি
মানুষের মতো
হতে গিয়ে
লক্ষ-লক্ষ বছরের সিঁড়ি
ভেঙে এসেছিলে,
তুমি
মাত্রই কয়েকটা সিঁড়ি টপকাবার ভুলে
মানুষ হওনি। এই
দুঃখে তুমি ঝিলের কিনারে
বসে ছিলে নাকি?
শিম্পাঞ্জি,
তোমাকে
আজ বড় বেশি দুঃখিত দেখলুম।
প্রায় হয়েছিলে,
তবু
সম্পূর্ণ মানুষ
হওনি, হয়তো
সেই দুঃখে তুমি আজ
দোলনায় উঠলে না;
তুমি
ছেলেবুড়ো দর্শক মজিয়ে
অর্ধমানবের মতো
নানাবিধ কায়দা দেখালে না।
হয়তো দেখনি তুমি,
কিংবা
দেখেছিলে,
দর্শকেরা
পুরোপুরি বাঁদুরে কায়দায়
তোমাকে
টিট্কিরি দিয়ে বাঘের খাঁচার দিকে চলে গেল।
ーーーーーーーーーー
আমল ক্রান্তি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
অমলকান্তি
আমার বন্ধু,
ইস্কুলে
আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ
দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ
জিজ্ঞেস করলে
এমন
অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে
ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা
কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি
সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে
রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ
কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম
আর জামরুলের পাতায়
যা
নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা
কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি
রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে
এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে
মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা
খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি
ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের
মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে
সে ডাক্তার হতে পারত,
যে
ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল
হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ,
সকলেরই
ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি
রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই
অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
ーーーーーーーーーーーーー
আল্প-একটু আকাশ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
অতঃপর
সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
জুঁইয়ের
গন্ধে বাতাস যেখানে মন্থর হয়ে আছে;
এবং
রেলিংয়ে ভর দিয়ে,
সেখান
থেকে অল্প-একটু আকাশ দেখা যায়।
আকাশ!
এতক্ষণে
তার মনে পড়ল,
সারাটা
সকাল, সারাটা বিকেল আর সন্ধ্যা
কাজের
পাথরে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে, মাথা ঠুকতে-ঠুকতে
মাথা
ঠোকাই তার সার হয়েছে।
কোনো-কিছুই
সে শুনতে পায়নি;
না
একটা গান, না একটু হাসি।
এখন
শুনবে।
কোনো-কিছুই
সে দেখতে পায়নি;
আন
একটা ফুল, না একটু আকাশ।
এখন
দেখবে।
রুগ্ণ
স্ত্রীকে মেজার-গ্লাসো-মাপা ওষুধ খাইয়ে,
কুঁচকে-যাওয়া
বালিশটাকে গুছিয়ে রেখে,
ঘুমন্ত
ছেলের ইজেরের দড়িটাকে আর-একটু আলগা করে দিয়ে,
সে তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
ーーーーーーーーーーーーーーー
আন্ধের
সমাজে একা
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
রাস্তার
দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি
চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান
সড়ক। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের
প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে
বসে কঠিন আঙুল।
যে-কোনো
মুহূর্তে ঘোর মারামারি হতে পারে, তবু
অস্ত্রগুলি
উল্টানো রয়েছে আপাতত।
পরস্পরের
দিকে পিঠ দিয়ে সকলে এখন
সম্মান
রচনা করে। আমি দেখি,
অযুত
নিযুত অন্ধ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপরে।
আমি
চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই।
আমি
সেনাপতি। আমি সৈন্য-পরিদর্শনে এসেছি।
কিন্তু
তার সেনাপতি, কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না।
আমি
শুধু দেখতে পাই, দশ লক্ষ যোদ্ধার সভায়
কাহারও
কপালে অক্ষিতারকার শোভা নেই;
কপালে
গভীর দুই গর্ত নিয়ে সবাই দাম্ভিক দাঁড়িয়েছে।
আমি
একা দেখতে পাই, আমি একা দেখতে পাই, আমি
দশ
লক্ষ যুযুধান অন্ধের সভায় আজ একা।
অথচ
অন্ধের দেশে একা চক্ষুষ্মান হওয়া খুব ভয়াবহ।
প্রধান
সড়কে তাই সৈন্য-পরিদর্শনের কালে
বারবার
চমকে উঠি। মনে হয়,
অন্ধের
সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার অধিক
বিড়ম্বনা
কিছু নেই, কখনও ছিল না।
রাস্তার
দুই ধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে যুদ্ধে সমুৎসুক
অন্ধ
সেনাদল।
আমি
হেঁটে যাই। আমি হেঁটে যেতে-যেতে
গুরুবন্ধনার
ছলে দেখে যাই, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরে
হতেছে সেঁকা, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে
বসে কঠিন আঙুল।
আপাতত
রণাঙ্গন নিস্তব্ধ যদিও,
আমি
তবু বুঝতে পারি, নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আগুনে
সর্বত্র
ভীষণ ধুমধাড়াক্কার উদ্যোগ চলেছে।
আমি
সেনাপতি। আমি প্রধান সড়ড়ে হেঁটে যাই।
অথচ
কখন যুদ্ধ শুরু হবে, কার যুদ্ধ, কিছুই জানি না।
কাহাকে
সমরে নেব, কিছুই জানি না!
(আমি
কার সেনাপতি, আমি কার সেনাপতি) আমি
অন্ধের
সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার বিপদ
টের
পেতে-পেতে আজ গুরুবন্দনার ছলে ভাবি,
এবার
পালানো ভাল দৌড়িয়ে। নতুবা
যদি
ভীমরবে সেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়, তবে–
যেহেতু
নিদানকালে চক্ষুলজ্জা ভয়াবহ, তাই–
নিজের
চক্ষুকে হয়তো নিজেরই নখরাঘাতে উপড়ে ফেলে দিয়ে
অন্ধের সমাজে আজ মিশে যেতে হবে।
ーーーーーーーーーーーーーーーー
ধ্বংশের আগে
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
তবে
ব্যর্থ হোক সব। উৎসব-উজ্জ্বল রজনীর
সমস্ত
সংগীত তবে কেড়ে নাও, নিত্য-সহচর
ব্যর্থবীর্য
শয়তানের আবির্ভাব হোক। তারপর
পাতালের
সর্বনাশা অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে
দৃঢ়
হাতে টেনে দাও যবনিকা। নির্মম অস্থির
পদক্ষেপে
আনো ভয়, বিস্বাদ বেদনা ঢেলে দাও;
ঢালো
গ্লানি, ঢালো মৃত্যু, শিল্পীর বেহালা ভেঙে ফেলে
অন্ধকার
রঙ্গমঞ্চে অট্টহাসি দু’হাতে ছড়াও।
কেননা
আমি তো শিল্পী। যে-মন্ত্রে সমস্ত হাহাকার
ব্যর্থ
হয়। মজ্জামাংস জোড়া লাগে ছিন্নভিন্ন হাড়ে,
যে-মন্ত্রে
উজ্জ্বল রক্ত নেমে আসে অস্থি-র পাহাড়ে
প্রাণের
রক্তিম ফুল ফুটে ওঠে মৃত্যুহীন গাছে,
সে-মন্ত্র
আমার জানা,–তাই মৃত্যু হানো যতবার
যে জানে প্রাণের মন্ত্র, কতটুকু
মৃত্যু তার কাছে।
ーーーーーーーーーーーーーー
নক্ষত্রজয়ের জন্যো
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
হুশ
করে নক্ষত্রলোকে উঠে যেতে চাই
কিন্তু
তার জন্য, মহাশয়,
স্প্রিং
লাগানো দারুণ মজবুত একটা শব্দের দরকার।
সেইটের
উপরে গিয়ে উঠতে হবে।
প্রাণপণে
বাতাস টেনে ফুসফুস ফুলিয়ে
নক্ষত্রলোকের
দিকে গর্বিত ভঙ্গিতে একবার
চোখ
রাখতে হবে।
তারপরে
প্রাণপণ জোরে লাথি মারতে হবে সেই শব্দের পাঁজরে!
আসলে
কী ব্যাপার জানেন,
রক্তের
ভিতরে একটা বিপরীত বিরুদ্ধ গতিকে
সঞ্চারিত
করা চাই।
একটা
শব্দ চাই, একটা শব্দ চাই, মহাশয়।
নক্ষত্রজয়ের
শব্দ কিছুতে পাচ্ছি না। তাই
আপাতত
কুকুরের
মতো একটা বশংবদ শব্দ দিন,
যেটাকে
পায়ের কাছে কিছুক্ষণ ইচ্ছেমতো নাচিয়ে খেলিয়ে,
ঘাড়ে
ধরে, ঘরের বাইরে বারান্দায়
ছুড়ে
দিতে পারি।
সুপুরির
মতো একটা শব্দ দিন,
যেটাকে
দাঁতের মধ্যে ভেঙে পিষে ছাতু করে দিয়ে
থুতুতে
মিশিয়ে আমি ঘৃণাভরে চারদিকে ছিটিয়ে দিতে পারি।
কিংবা–কিংবা–
বুঝতেই
পারছেন, সব নাট-বল্টু একে-একে খুলে যাচ্ছে;
বুঝতেই
পারছেন, নৌকো ফেঁসে যাচ্ছে;
বুঝতেই
পারছেন, আমি ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছি, মহাশয়।
‘খ্যাপা
খুঁজে-খুঁজে ফেরে পরশপাথর।’
আমি
একটা শব্দ খুঁজছি, মহাশয়।
নক্ষত্রলোকের
দিকে যাব বলে আমি
চল্লিশ
বছর ধরে হাটেমাঠে টই-টই রোদ্দুরে
বিস্তর
শব্দের ঘাড় মটকালুম। অথচ দেখুন,
‘আচমন’-এর
তুল্য কোনো সুলক্ষণ শব্দ আমি এখনও পাইনি।
দুই
কশে গড়াচ্ছে রক্ত, চক্ষু লাল, বুকের ভিতরে
গনগনে
আগুন জ্বেলে
চল্লিশ
বছর ধরে শুধু আমি হাতের চেটোর উলটো পিঠে
কপাল
ঘষছি।
অথচ
ভাবুন,
কিছু
সুলক্ষণ শব্দ হাতের সামনেই ছিল কি না।
বহু
সুলক্ষণ শব্দ হাতের সামনেই ছিল, কিন্তু আমি আজ
আচমকা
তাদের দেখলে চিনতে পারি না।
একদা-দুর্দান্ত-কিন্তু-রকবাজের-হাতে-পড়ে-নষ্ট-হয়-যাওয়া
সমুন্নত
সুন্দর-ললাট বহু শব্দ ইদানীং
হাড্ডিসার,
রাস্তায়
দাঁড়িয়ে বিড়ি ফোঁকে।
জাহাজ,
পতন,
মৃত্যু,
মাস্তুল
প্রমুখ
পরাক্রান্ত
শব্দগুলি
এখন
ক্রমেই
ইঁদুরের
মতন ছুঁচলো-মুখ হয়ে যাচ্ছে, মহাশয়।
পাউডার-পমেড-মাখা
যে-কোনো ছোকরার
পুরনো
কম্বলে লাথি ঝাড়লেই ‘পতন’ ‘মৃত্যু’ ‘মাস্তুল’ ইত্যাদি
ইঁদুর
কিচকিচ করে ওঠে।
কিচকিচ
কিচকিচ, শুধু কিচকিচ কিচকিচ ছাড়া ইদানীং
অন্য-কোনো
ধ্বনি
শুনতে
পাই না!
শুধুই
লোভের ধূর্ত মার্কামারা মুখ ভিন্ন অন্য-কোনো মুখ
দেখতে
পাই না।
বুঝতেই
পারছেন, সব নাট-বল্টু একে-একে খুলে যাচ্ছে;
বুঝতেই
পারছেন, নৌকো ফেঁসে যাচ্ছে,
বুঝতেই
পারছেন, আমি ক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছি, মহাশয়।
অথচ
এখনও আমি সুলক্ষণ একটা-কোনো শব্দের উপরে
সওয়ার
হবার জন্যে বসে আছি।
অথচ
এখনও আমি নক্ষত্রলোকের দিকে যেতে চাই।
অথচ
এখনও আমি মেঘের পৈঠায় মা ঝুলিয়ে
জ্যোৎস্নায়
কুলকুচো করব, এইরকম আশা রাখি।
একটা
শব্দ দিন, একটা শব্দ দিন, মহাশয়।
রক্তের
ভিতরে ঘোর জলস্তম্ভ ঘটিয়ে যা মুহূর্তে আমাকে
শূণ্যলোকে
ছুড়ে দেবে–
চাঁদমারি-খসানো
আমি এমন একটাই মাত্র শব্দ চাই।
নেই
নাকি?
তবে
দিন,
বুলেটের
মতো একটা শব্দ দিন। আমি
যেটাকে
বন্দুকে পুরে, ট্রিগারে আঙুল রেখে–কড়াক পিং–
নকল
বুঁদির কেল্লা ভেঙে দিয়ে ফাটা কপালের রক্ত মুছে
হেসে উঠতে পারি।
ーーーーーーーーーーーーーーー
নদী কিছু চাই
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
নদী
গ্রাস করে নিচ্ছে সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি।
নিকোনো
উঠোন থেকে ঠাকুরদালানে,
ঘরে,
বারান্দায়,
সবখানে
এখন
দিনে ও রাত্রে শুনে যাই তারই
তরঙ্গের
ছলোচ্ছল শব্দ। আমি ঘুমের ভিতরে
ডুবে
গিয়ে যে-শব্দ শুনেছি চিরকাল,
বিনিদ্র
প্রহরে আজ উথালপাথাল
সেই
শব্দ চতুর্দিকে ঘোরে।
নদী
কিছু চেয়েছিল, চেয়েও পায়নি, তাই তার
জল
উঠে এসেছিল সীমানা ছাড়িয়ে।
সবকিছু
ভেঙেচুরে পেটের ভিতরে টেনে নিয়ে
সে
তাই আবার
ফিরে
গেছে নিজের নির্দিষ্ট সীমানায়।
শুধুই দেয় না নদী, কিছু
চায়, চিরকাল চায়।
ーーーーーーーーーーーーーー
নীজের বাড়ি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
ভাবতে
ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই শান্ত উঠোন,
এই
খেত, ওই মস্ত খামার–
সবই
আমার।
এবং
আমি ইচ্ছে হলেই পারি
ইচ্ছেমতন
জানলা-দরজা খুলতে।
ইচ্ছেমতন
সাজিয়ে তুলতে
শান্ত
সুখী একান্ত এই বাড়ি।
ভাবতে
ভাল লেগেছিল, চেয়ার টেবিল,
আলমারিতে
সাজানো বই, ঘোমটা-টানা নরম আলো,
ফুলদানে
ফুল, রঙের বাটি,
আলনা
জুড়ে কাপড়-জামার
সুবিন্যস্ত
সমারোহ, সবই আমার।
এবং
আমি ইচ্ছে হলেই পারি
দেয়ালে
লাল হলুদ রঙের কাড়াকাড়ি
মুছে
ফেলতে সাদার শান্ত টানে।
এই
যে বাড়ি, এই তো আমার বাড়ি।
ভাবতে
ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই ঠাণ্ডা উঠোন,
এই
খেত, ওই মস্ত খামার,
আলমারিতে
সাজানো বই,
ফুলদানে
ফুল, রঙের বাটি,
টবের
গোলাপ, নরম আলো,
আলনা
জুড়ে কাপড়-জামার
শৃঙ্খলিত
সমারোহ, সবই আমার, সব-ই আমার।
ভাবতে
ভাল লেগেছিল, কাউকে কিছু না জানিয়ে
হঠাৎ
কোথাও চলে যাব।
ফিরে
এসে আবার যেন দেখতে পারি,
যে-নদী
বয় অন্ধকারে, তারই বুকের কাছে
বাড়িটা
ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ওই যে বাড়ি, ওই তো আমার
বাড়ি।
ーーーーーーーーーーーー
মৌলিক
নিষাদ
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তি
পিতামহ,
আমি
এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে
রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে
রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি
একটিও তারা আজ।
পিতামহ,
আমি
এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি
আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে
তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে
তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ,
আমি
এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।
এই
এক আশ্চর্য সময়।
যখন
আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন
নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ
তা জানে না।
যখন
পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ
তা জানে না।
পিতামহ,
আমি
এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন
আকাশে আলো নেই,
যখন
মাটিতে আলো নেই,
যখন
সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে
নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ–ভয়।
পিতামহ,
তোমার
আকাশ
নীল–কতখানি
নীল ছিল?
আমার
আকাশ নীল নয়।
পিতামহ,
তোমার
হৃদয়
নীল–করখানি
নীল ছিল?
আমার
হৃদয় নীল নয়।
আকাশের,
হৃদয়ের
যাবতীয় বিখ্যাত নীলিমা
আপাতত
কোনো-এক স্থির অন্ধকারে শুয়ে আছে।
পিতামহ,
আমি
সেই ভয়ের দরুণ অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে
রয়েছি! পিতামহ,
দাঁড়িয়ে
রয়েছি, আর চেয়ে দেখেছি, রাত্রির আকাশে
ওঠেনি
একটাও তারা আজ।
মনে
হয়, আমি এক অমোঘ মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি
আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে
তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে
তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার
অন্ধকারে জেগে আছে মৌলিক নিষাদ–এই ভয়।
ーーーーーーーーーーーーーーー
🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏