ভালবাসার কবিতা
অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারেই যেন
ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে
যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে
মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ
গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে
যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই
অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন
বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে
চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী
ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী
ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে
ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের
হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে
করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর
নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম
নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই
চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে
তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ,
নিখিলের
দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের
মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল
কবির গীতি।
অভিমান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কারে দিব দোষ
বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন,
বৃথা
কর রোষ।
যারা শুধু মরে
কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের
করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি,
যত
দিই গালি,
কালামুখে পড়ে
তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান
করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি
পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি
নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে
যদি না পার ফিরাতে--
তবে ঘরে নতশিরে
চুপ করে থাক্,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে
বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর
অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী
আর শুধু অশ্রুজল।
—————————————
কাগজের নৌকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছুটি হলে রোজ
ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে
আপনার নাম,
লিখি আমাদের
বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো করে
মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা
আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে
পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন
পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে
অনুমানি
কার কাছ হতে
ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি
।।
আমার নৌকা সাজাই
যতনে
শিউলি বকুলে
ভরি।
বাড়ির বাগানে
গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল
সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে
ঝলমল্
প্রভাতের আলো
পড়ি।
সেই কুসুমের অতি
ছোটো বোঝা
কোন্ দিক-পানে
চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি
পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে
যেয়ে -
প্রভাতের ফুল
সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী
বেয়ে ।।
আমার নৌকা
ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি
তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ
উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে
ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি
চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে
ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ
ভাসে কত
আমারি সে ছোটো
নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়,
কোথা
ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে
লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী
আমার
কে যাবে কাহার
আগে ।।
বেলা হলে শেষে
বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে
টানি
আমি ঘরে ফিরি,
থাকি
কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন
সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্
গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্ পথে যাবে
কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু
নাহি করে মানা,
ধরে নাহি রাখে,
ফিরে
নাহি ডাকে -
ধায় নব নব
দেশে।
কাগজের তরী,
তারি
পরে চড়ি
মন যায় ভেসে
ভেসে ।।
রাত হয়ে আসে,
শুই
বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই
হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি
এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা
নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে
কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে
রাতে।
আকাশের তারা
মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে
প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর
খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে
ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে
চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া
মাসি ।
যাত্রাভঙ্গ
নির্মলেন্দু গুণ
হাত বাড়িয়ে ছুঁই
না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক
করি না
এক কে করি দুই।
হেমের মাঝে শুই
না যবে,
প্রেমের মাঝে
শুই
তুই কেমন কর
যাবি?
পা বাড়ালেই
পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই
পাবি।
তবুও তুই বলিস
যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে
পথ নাই।
তখন আমি একটু
ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব
তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার
নায়ে,
আমার বৈতরণী
নায়ে।
নায়ের মাঝে বসবো
বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব
না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।
তোমার চোখ
এতো লাল কেন
নির্মলেন্দু গুণ
আমি বলছি না
ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার
জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর
থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে
দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না
ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে
দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে
বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি,
এই
ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি
দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ
একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে
কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার
সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা
শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন,
গেঞ্জি-রুমাল
আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না
ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর
থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ
আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার
সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : 'তোমার
চোখ এতো লাল কেন ?'
————————————————
————————————————
শুধু তোমার জন্য
নির্মলেন্দু গুণ
কতবার যে আমি
তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি
হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে
ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে
কথা বলিনি
সে কথা আমার
ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের
মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে
চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল;
তুমি
এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী
শুনলাম
এমত উল্লাসে
নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম
একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি,
সে-কথা
আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে
তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর
এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর
জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন
পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম
তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
ওটা কিছু নয়
নির্মলেন্দু গুণ
এইবার হাত দাও,
টের
পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও আমি
তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও,
টের
পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ
চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার
আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,--না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা
কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য,
ওটা
অগ্নি নয়, অই আমি--আমার যৌবন ।
সুখের সামান্য
নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ--প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ
তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা
না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে
ঘাসে,--এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও,
হ্যাঁ,
ওটা
বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।
অইখানে থাকে
প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি
;
অই বুকে প্রেম
ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।
কথা আছে
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়
বহুক্ষণ
মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা
দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে
চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম
খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা,
ব্লাউজের
নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের
শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ,
রোদ
গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির
অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে
স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে
থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে
আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে
কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী
হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে,
কথা
আছে, ঢের কথা আছে।
চোখ নিয়ে চলে
গেছে
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়
এই যে বাইরে হু
হু ঝড়, এর চেয়ে বেশী
বুকের মধ্যে আছে
কৈশোর জুড়ে
বৃষ্টি বিশাল, আকাশে থাকুক যত মেঘ,
যত ক্ষণিকা
মেঘ উড়ে যায়
আকাশ ওড়ে না
আকাশের দিকে
উড়েছে নতুন সিঁড়ি
আমার দু বাহু
একলা মাঠের জারুলের ডালপালা
কাচ ফেলা নদী
যেন ভালোবাসা
ভালোবাসার মতো
ভালোবাসা
দু‘দিকের পার
ভেঙে
নরীরা সবাই
ফুলের মতন, বাতাসে ওড়ায়
যখন তখন
রঙিন পাপড়ি
বাতাস তা জানে,
নারীকে
উড়াল দেয়ে নিয়ে যায়
তাই আমি আর
প্রকৃতি দেখি না,
প্রকৃতি আমার
চোখ নিয়ে চলে গেছে!
কেউ কথা রাখেনি
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখেনি,
তেত্রিশ
বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক
বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর
দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত
চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর
প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির
মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন
প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে
পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী,
আমি
আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ
স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল
দেখাবে?
একটাও রয়্যাল
গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স
দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন
চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের
ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে
হেসেছে
আমার দিকে তারা
ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ
ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ,
আমাদের
দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল
গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ
ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে
সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায়
সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার
বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য
আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের
চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন
তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি
বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো
নারী।
কেউ কথা রাখেনি,
তেত্রিশ
বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
কেউ তা বোঝে
না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা
তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন
কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায়
আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমন কি সুরা এমন
কি ভাষা
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
বিকেল
বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে
ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি
না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না
কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কি আছে অথবা কি ছিল
আমার কি আছে
অথবা কি ছিল
ফুলের
ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন
আগুন আগুন আগুন
মন ভাল নেই মন ভাল নেই মন ভাল নেই
তবু দিন
কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায়
আশায়
আশায় আশায়
—————————————————
ভালবাসার সময়
তো নেই
রুদ্র মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
ভালবাসার সময়
তো নেই
ব্যস্ত ভীষন
কাজে,
হাত রেখো না
বুকের গাড় ভাজে।
ঘামের জলে ভিজে
সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না,
হৃদয়-
রোদ দূরে।
কাজের মাঝে দিন
কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয়
ঘড়ায় তোলা জল।
নদী আমার বয় না
পাশে
স্রোতের দেখা
নেই,
আটকে রাখে
গেরস্থালির লেই।
তোমার দিকে
ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল
সামাজিক নখ।
উল্টো ঘুড়ি
রুদ্র মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
এতো সহজেই
ভালোবেসে ফেলি কেন!
বুঝি না আমার
রক্তে কি আছে নেশা-
দেবদারু-চুলে
উদাসী বাতাস মেখে
স্বপ্নের চোখে
অনিদ্রা লিখি আমি,
কোন বেদনার
বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত?
সহজেই আমি
ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু-
না-বলা কথায়
তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,
যেন লাল ঘুড়ি
একটু বাতাস পেয়ে
উড়াই নিজেকে
আকাশের পাশাপাশি।
সহজে যদিও
ভালোবেসে ফেলি
সহজে থাকি না
কাছে,
পাছে বাঁধা পড়ে
যাই।
বিস্মিত তুমি
যতোবার টানো বন্ধন-সুতো ধ’রে,
আমি শুধু যাই
দূরে।
আমি দূরে যাই-
স্বপ্নের চোখে
তুমি মেখে নাও ব্যথা-চন্দন চুয়া,
সারাটি রাত্রি
ভাসো উদাসীন বেদনার বেনোজলে…
এতো সহজেই ভালোবেসে
ফ্যালো কেন?
দূরে আছো দূরে
রুদ্র মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
তোমাকে পারিনি
ছুঁতে, তোমার তোমাকে-
উষ্ণ দেহ ছেনে
ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,
পরস্পর খুড়ে
খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।
তোমার তোমাকে
আমি ছুঁতে পারি নাই।
যেভাবে ঝিনুক
খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে
আমাকে খুলেই
তুমি পেয়েছো অসুখ,
পেয়েছো
কিনারাহীন আগুনের নদী।
শরীরের তীব্রতম
গভীর উল্লাসে
তোমার চোখের
ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি-
তোমার তোমাকে
আমি ছুঁতে পারি নাই।
জীবনের ’পরে
রাখা বিশ্বাসের হাত
কখন শিথিল হয়ে
ঝ’রে গেছে পাতা।
কখন হৃদয় ফেলে
হৃদপিন্ড ছুঁয়ে
বোসে আছি উদাসীন
আনন্দ মেলায়-
তোমাকে পারিনি
ছুঁতে-আমার তোমাকে,
ক্ষাপাটে
গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি
তছ নছ কোরে গেছি
শান্ত আকাশের।
অঝোর বৃষ্টিতে
আমি ভিজিয়েছি হিয়া-
তোমার তোমাকে
আমি ছুঁতে পারি নাই।।
————————————————
খতিয়ান
রুদ্র মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
‘হাত বাড়ালেই
মুঠো ভরে যায় ঋণে
অথচ আমার শস্যের
মাঠ ভরা।
রোদ্দুর খুঁজে
পাই না কখনো দিনে,
আলোতে ভাসায়
রাতের বসুন্ধরা।
টোকা দিলে ঝরে
পচা আঙুলের ঘাম,
ধস্ত তখন মগজের
মাস্তুল
নাবিকেরা ভোলে
নিজেদের ডাক নাম
চোখ জুড়ে ফোটে
রক্তজবার ফুল।
ডেকে ওঠো যদি
স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে,
উড়াও নীরবে
নিভৃত রুমালখানা
পাখিরা ফিরবে পথ
চিনে চিনে ঘরে
আমারি কেবল
থাকবে না পথ জানা–
টোকা দিলে ঝরে
পড়বে পুরনো ধুলো
চোখের কোণায়
জমা একফোঁটা জল।
কার্পাস ফেটে
বাতাসে ভাসবে তুলো
থাকবে না শুধু
নিবেদিত তরুতল
জাগবে না
বনভূমির সিথানে চাঁদ
বালির শরীরে
সফেদ ফেনার ছোঁয়া
পড়বে না মনে
অমীমাংসিত ফাঁদ
অবিকল রবে
রয়েছে যেমন শোয়া
হাত বাড়ালেই
মুঠো ভরে যায় প্রেমে
অথচ আমার ব্যাপক
বিরহভূমি
ছুটে যেতে চাই–
পথ যায় পায়ে থেমে
ঢেকে দাও চোখ
আঙুলের নখে তুমি।
————————————————
টিউটোরিয়াল
জয় গোস্বামী
তোমাকে পেতেই
হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে
একদম প্রথম
তার বদলে মাত্র
পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম
কেন? কেন কম?
এই জন্য আমি রোজ
মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?
এই জন্যে তোমার
মা কাক ভোরে উঠে সব কাজকর্ম সেরে
ছোটবেলা থেকে
যেতো তোমাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে?
এই জন্য কাঠফাটা
রোদ্দুরে কি প্যাচপ্যাচে বর্ষায়
সারাদিন বসে
থাকতো বাড়ির রোয়াকে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে?
তারপর ছুটি হতে,
ভিড়
বাঁচাতে মিনিবাস ছেড়ে
অটো-অলাদের ঐ
খারাপ মেজাজ সহ্য করে
বাড়ি এসে,
না
হাঁপিয়ে, আবার তোমার পড়া নিয়ে
বসে পড়তো,
যতক্ষণ
না আমি বাড়ি ফিরে
তোমার হোমটাস্ক
দেখছি, তারপরে আঁচলে মুখ মুছে
ঢুলতো গিয়ে
ভ্যাপসা রান্নাঘরে?
এই জন্যে?
এই
জন্যে হাড়ভাঙা ওভারটাইম করে
তোমার জন্য
আন্টি রাখতাম?
মোটা মাইনে,
ভদ্রতার
চা-জলখাবার
হপ্তায় তিনদিন,
তাতে
কত খরচা হয় রে রাস্কেল?
বুদ্ধি আছে সে
হিসেব করবার?
শুধু ছোটকালে নয়,
এখনো
যে টিউটোরিয়ালে
পাঠিয়েছি,
জানিস
না, কিরকম খরচাপাতি তার?
ওখানে একবার
ঢুকলে সবাই প্রথম হয়। প্রথম, প্রথম!
কারো অধিকার নেই
দ্বিতীয় হওয়ার।
রোজ যে যাস,
দেখিস
না কত সব বড় বড়
বাড়ি ও পাড়ায়
কত সব গাড়ি আসে,
কত
বড় আড়ি করে
বাবা মা-রা
ছেলেমেয়েদের নিতে যায়?
আর ঐ গাড়ির পাশে,
পাশে
না পিছনে-
ঐ অন্ধকারটায়
রোজ দাঁড়াতে দেখিস
না নিজের বাবাকে?
হাতে অফিসের
ব্যাগ, গোপন টিফিন বাক্স, ঘেমো জামা, ভাঙা মুখ -
দেখতে পাসনা?
মন
কোথায় থাকে?
ঐ মেয়েগুলোর
দিকে? যারা তোর সঙ্গে পড়তে আসে?
ওরা তোকে পাত্তা
দেবে? ভুলেও ভাবিস না!
ওরা কত বড়লোক!
তোকে পাত্তা
পেতে হলে থাকতে হবে বিদেশে, ফরেনে
এন আর আই হতে
হবে! এন আর আই, এন আর আই!
তবেই ম্যাজিক
দেখবি
কবিসাহিত্যিক
থেকে মন্ত্রী অব্দি একডাকে চেনে
আমাদেরও নিয়ে
যাবি, তোর মাকে, আমাকে
মাঝে মাঝে রাখবি
নিজের কাছে এনে
তার জন্য প্রথম
হওয়া দরকার প্রথমে
তাহলেই ছবি
ছাপবে খবর কাগজ
আরো দরজা খুলে
যাবে, আরো পাঁচ আরো পাঁচ
আরো আরো পাঁচ
পাঁচ পাঁচ করেই
বাড়বে, অন্য দিকে মন দিস না,
বাঁচবি তো
বাঁচার মত বাঁচ!
না বাপী না,
না
না বাপী, আমি মন দিই না কোনোদিকে
না বাপী না,
না
না আমি তাকাই না মেয়েদের দিকে
ওরা তো পাশেই
বসে, কেমন সুগন্ধ আসে, কথা বলে, না না বাপী পড়ার
কথাই
দেখি না,
উত্তর
দিই, নোট দিই নোট নিই
যেতে আসতে পথে
ঘাটে
কত ছেলে মেয়ে
গল্প করে
না বাপী না,
আমি
মেয়েদের সঙ্গে মিশতে যাই না কখোনো
যেতে আসতে দেখতে
পাই কাদা মেখে কত ছেলে বল খেলছে মাঠে
কত সব দুষ্টু
ছেলে পার্কে প্রজাপতি ধরছে
চাকা বা
ডাঙ্গুলি খেলছে কত ছোটোলোক
না, আমি
খেলতে যাই না কখোনো
খেলতে যাইনি। না
আমার বন্ধু নেই
না বাপী না,
একজন
আছে, অপু, একক্লাসে পড়ে
ও বলে যে ওর
বাবাও বলেছে প্রথম হতে
বলেছে, কাগজে
ছবি, ওর বাবা, ওকে ….
হ্যাঁ বাপী
হ্যাঁ, না না বাপী, অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম
বলেছে ও ব্যাক
পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায়
বাথরুম সাফ করার
অ্যাসিড আছে ও জানে,
হ্যাঁ বাপী
হ্যাঁ, ও বলেছে,
উঠে যাবে কাগজের
প্রথম পাতায় ….
আজ যদি আমাকে
জিগ্যেস করো
জয় গোস্বামী
আজ যদি আমাকে
জিগ্যেস করো : ‘এই জীবন নিয়ে
তুমি কি করেছো এতদিন
?’— তাহলে আমি বলবো
একদিন বমি
করেছিলাম, একদিন ঢোঁক
গিলেছিলাম,
একদিন
আমি ছোঁয়া মাত্র জল
রুপান্তরিত
হয়েছিল দুধে, একদিন আমাকে দেখেই
এক অপ্সরার মাথা
ঘুরে গিয়েছিল একদিন
আমাকে না বলেই
আমার দুটো হাত
কদিনের জন্য উড়ে
গেছিল হাওয়ায়
একদিন মদ হিসেবে
ঢুকেছিলাম এক
জবরদস্ত মাতালের
পেটে, একদিন সম্পূর্ণ
অন্যভাবে বেরিয়ে
এসেছিলাম এক
রূপসীর
শোকাশ্রুরুপে, আর তৎক্ষণাৎ
আহা উহু আহা উহু
করতে করতে আমাকে
শুষে নিয়েছিল
বহুমূল্য মসলিন
একদিন গায়ে হাত
তুলেছিলাম
একদিন পা
তুলেছিলাম
একদিন জিভ
ভেঙিয়েছিলাম
একদিন সাবান
মেখেছিলাম
একদিন সাবান
মাখিয়েছিলাম যদি
বিশ্বাস না হয়
তো জিগ্যেস করুন আমার মৃত্যুকে
একদিন কা কা করে
ডেকে বেরিয়েছিলাম সারাবেলা
একদিন তাড়া
করেছিলাম স্বয়ং কাকতাড়ুয়াকেই
একদিন শুয়োর
পুষেছিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ একদিন ছাগল
একদিন দোদোমা
ফাটিয়েছিলাম, একদিন চকলেট
একদিন বাঁশি
বাজিয়েছিলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ একদিন রাধাকেও
একদিন আমার মুখ
আমি আচ্ছা ক’রে গুঁজে দিয়েছিলাম
একজনের কোলে আর
আমার বাকি শরীরটা তখন
কিনে নিয়েছিল
অন্য কেউ কে তা আমি এখনো জানি না যদি
বিশ্বাস না হয়
তো জিগ্যেস করো গিয়ে তোমার…
একদিন আমার শরীর
ছিল তরুণ পাতায় ভরা
আর আমার আঙুল
ছিল লম্বা সাদা বকফুল
আমার চুল ছিল
একঝাঁক ধূসর রঙের মেঘ
হাওয়া এলেই
যেখানে খুশি উড়ে যাবে, কেবল সেইজন্য—
একদিন মাঠের পর
মাঠে আমি ছিলাম বিছিয়ে রাখা ঘাস
তুমি এসে শরীর
ঢেলে দেবে, কেবল সেইজন্য—
আর সমস্ত
নিষেধের বাইরে ছিল
আমার দুটো চোখ
এ নদী থেকে ও
নদী থেকে সেই সে নদীতে
কেবলই ভেসে
বেড়াতো তারা
সেই রকমই কোনো
নদীর উপর, রোগা একটা সাঁকোর মতো
একদিন আমি পেতে
রেখেছিলাম আমার সাষ্টাঙ্গ শরীর
যাতে এপার থেকে
ওপারে চলে যেতে পারে লোক
কোনো বাধা-নিষেধ
ছাড়াই
যাতে ওপার থেকে
এপারে চলে আসতে পারে লোক
কোনো বাধা-নিষেধ
ছাড়াই
সেই সাঁকোর উপর
দিয়ে একদিন এপার থেকে
ওপারে চলে
গিয়েছিল আসগর আলি মণ্ডলরা বাবুল ইসলামরা
সেই সাঁকোর উপর
দিয়ে একদিন ওপার থেকে
এপারে চলে
এসেছিল তোমার নতুন শাড়ি-পরা মা,
টেপ-জামা-পরা
আমার সান্তুমাসী
একদিন সংবিধান
লিখতে লিখতে একটু
তন্দ্রা এসে
গিয়েছিল আমার দুপুরের ভাত-ঘুম মতো এসেছিল একটু
আর সেই ফাঁকে
কারা সব এসে ইচ্ছে মতো
কাটাকুটি করে
গিয়েছে দেহি পদপল্লব মুদারম্
একদিন একদম
ন্যাংটো হয়ে
ছুটতে ছুটতে
চৌরাস্তার মোড়ে এসে আমি পেশ করেছিলাম
বাজেট
একদিন হাঁ
করেছিলাম একদিন হাঁ বন্ধ করেছিলাম
কিন্তু আমার
হা-এর মধ্যে কোনো খাবার ছিল না
কিন্তু আমার
না-এর মধ্যে কোনো খাবার ছিল না
একদিন দুই গাল
বেয়ে ঝরঝর ক’রে রক্তগড়ানো অবস্থায়
জলে কাদায়
ধানক্ষেত পাটক্ষেতের মধ্যে
হাতড়ে হাতড়ে আমি
খুঁজে ফিরেছিলাম আমার উপড়ে নেওয়া চোখ
একদিন পিঠে
ছরা-গাঁথা অবস্থায়
রক্ত কাশতে
কাশতে আমি আছড়ে এসে পরেছিলাম দাওয়ায়
আর দলবেঁধে,
লণ্ঠন
উঁচু করে, আমায় দেখতে এসেছিল গ্রামের লোক
একদিন দাউদাউ
ক’রে জ্বলতে থাকা ঝোপঝাড় মধ্য থেকে
সারা গায়ে আগুন
নিয়ে আমি ছুটে বেরিয়েছিলাম আর
লাফ দিয়েছিলাম
পচা পুকুরে
পরদিন কাগজে সেই
খবর দেখে আঁতকে উঠেছিলাম
উত্তেজিত
হয়েছিলাম। অশ্রুপাত করেছিলাম, লোক জড়ো করেছিলাম,
মাথা
ঘামিয়েছিলাম আর সমবেত সেই মাথার ঘাম
ধরে রেখেছিলাম
দিস্তে দিস্তে দলিলে—যাতে
পরবর্তী কেউ এসে
গবেষণা শুরু করতে পারে যে
এই দলিলগুলোয়
আগুন দিলে ক’জনকে পুড়িয়ে মারা যায়
মারো মারো মারো
স্ত্রীলোক ও
পুরুষলোকের জন্যে আয়ত্ত করো দু ধরনের প্রযুক্তি
মারো মারো মারো
যতক্ষণ না মুখ
দিয়ে বমি করে দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড
মারো মারো মারো
যতক্ষণ না পেট
থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে পেটের বাচ্চা
মারো মারো মারো
মারো মারো-ও-ও-ও
এইখানে এমন এক
আর্তনাদ ব্যবহার করা দরকার
যা কানে লাগলে
টুকরো টুকরো হয়ে যাবে মাথার খুলি
এইখানে এমন এক
সঙ্গম ব্যাবহার করা দরকার
যার ফলে অর্ধেক
শরীর চিরকালের মতো পুঁতে যাবে ভূগর্ভে আর
দ্রুত কয়লা হয়ে
যাবে
এইখানে এমন এক
থুতু নিক্ষেপ করা দরকার
যে-থুতু মুখ
থেকে বেরোনো মাত্রই বিদীর্ণ হবে অতিকায় নক্ষত্ররুপে
এইখানে এমন এক
গান ব্যাবহার করা দরকার যা গাইবার সময়
নায়ক-নায়িকা
শূনে উঠে গিয়ে ভাসতে থাকবে আর তাদের
হাত পা মুণ্ডু ও
জননেন্দিয়গুলি আলাদা আলাদা হয়ে আসবে
ও প্রতিটি
প্রতিটির জন্যে কাঁদবে প্রতিটি প্রতিটিকে আদর করবে ও
একে অপরের নিয়ে
কী করবে ভেবে পাবে না, শেষে
পূর্বের অখণ্ড
চেহারায় ফিরে যাবে
এইখানে এমন এক
চুম্বন-চেষ্টা প্রয়োগ করা দরকার, যার ফলে
‘মারো’ থেকে ‘ও’
অক্ষর
‘বাচাও’ থেকে ‘ও’
অক্ষর
তীব্র এক
অভিকর্ষজ টানে ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে
পরস্পরের দিকে
ছুটে যাবে এবং এক হয়ে যেতে চাইবে
আর আবহমানকালের
জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মুখ
আকাশের দিকে
উত্তোলিত তাদের গোল হয়ে থাকা হাঁ
একটি অনন্ত ‘ও’
ধ্বনিতে স্তব্ধ হয়ে থাকবে
আজ যদি আমায়
জিগ্যেস করো শত শত লাইন ধ’রে তুমি
মিথ্যে লিখে
গিয়েছো কেন ?
যদি জিগ্যেস করো
একজন কবির কাজ কী হওয়া উচিত
কেন তুমি এখনো
শেখোনি ?—তাহলে
আমি শুধু বলবো
একটি কণা,
বলবো, বালির
একটি কণা থেকে আমি জন্মেছিলাম, জন্মেছিলাম
লবণের একটি দানা
থেকে—আর অজানা অচেনা এক বৃষ্টিবিন্দু
কত উঁচু সেই
গাছের পাতা থেকেও ঠিক দেখতে পেয়েছিল আমাকে
আর ঝরেও পড়েছিল
আমার পাশে—এর বেশি আমি আর
কিচ্ছু জানি
না……
আজ যদি আমাকে
জিগ্যেস করো কোন্ ব্যূহ কোন্ অন্ধকুপ
রাষ্টের কোন্
কোন্ গোপন প্রণালীর ভেতর তুমি ঘুরে
বেরিয়েছো তুমি
বেড়াতে গিয়েছো কোন্ অস্ত্রাগারে তুমি চা খেয়েছো এক
কাপ
তুমি মাথা
দিয়ে ঢুঁসিয়েছো কোন্ হোর্ডিং কোন্
বিজ্ঞাপন কোন্ ফ্লাইওভার
তোমার পায়ের
কাছে এসে মুখ রেখেছে কোন্ হরিণ
তোমার কাছে গলা
মুচড়ে দেওয়ার আবেদন এনেছে কোন্
মরাল
তাহলে আমি বলবো
মেঘের উপর দিয়ে
মেঘের উপর দিয়ে মেঘের উপর
আমি কেবল উড়েই
বেড়াইনি
হাজার হাজার
বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় আমি
লাফিয়ে লাফিয়ে
নেচে বেরিয়েছি মাঠে আর জনপদে
আজ যদি আমায়
জিগ্যেস করো :
তুমি একই বৃন্তে
ক’টি কুসুম
তুমি শাণ্ডিল্য
না ভরদ্বাজ
তুমি দুর্লভ না
কৈবর্ত
তুমি ব্যাটারি
না হাত-বাক্স
তুমি পেঁপে গাছ
না আতা গাছ
তুমি চটি পায়ে
না জুতো পায়ে
তুমি চণ্ডাল না
মোছরমান
তুমি মরা শিলা
না জ্যান্ত শিলা
তা হলে আমি বলবো
সেই রাত্রির কথা, যে-রাত্রে
শান্ত ঘাসের মাঠ
ফুঁড়ে নিঃশব্দে নিঃশব্দে
চতুর্দিকে মাটি
পাথর ছিটকোতে ছিটকোতে তীব্রগতিতে আমি উড়তে
দেখেছিলাম
এক কুতুন মিনার,
ঘূর্ণ্যমান
কুতুব মিনার
কয়েক পলকে শূনে
মিলিয়ে যাবার আগে
আকাশের গায়ে তার
ধাবমান আগুনের পুচ্ছ থেকে আমি সেদিন
দুদিকে দু’হাত
ভাসিয়ে দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম ফেনায় তোলপাড়
এই
সময় গর্ভে……
আজ আমি দূরত্বের
শেষ সমুদ্রে আর জলের নিচে লোহার চাকা পাক খায়
আজ আমি সমুদ্রের
সেই সূচনায় আর জলের নিচে লোহার চাকা পাক খায়
যা-কিছু শরীর
অশরীর তা-ই আজ আমার মধ্যে জেগে উঠছে প্রবল প্রাণ
আজ আমি দুই
পাখনায় কাটতে কাটতে চলেছি সময়
অতীত আর ভবিষ্যৎ
দুই দিকে কাটতে কাটতে চলেছি সময় এক অতিকায়
মাছ
আমার ল্যাজের
ঝাপটায় ঝাপটায় গড়ে উঠছে জলস্তম্ভ ভেঙে পরছে
জলস্তম্ভ
আমার নাক দিয়ে
ছুঁড়ে দেওয়া ফোয়ারায় উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে জ্বলন্ত
মেঘপুঞ্জ
আমার নাসার
উপরকার খড়্গে বাঁধা রয়েছে একটি রশি
যার অপরপ্রান্ত
উঠে গেছে অনেক অনেক উপরে
এই পৃথিবী ও
সৌরলোকের আকর্ষণসীমার বাইরে
যেখানে প্রতি
মুহূর্তে ফুলে ফুলে উঠছে অন্ধকার ঈথার
সেইখানে,
একটি
সৌরদ্বীপ থেকে আরেক সৌরদ্বীপের মধ্যপথে
দুলতে দুলতে,
ভাসতে
ভাসতে চলেছে একটি আগ্নেয় নৌকা……
এর বেশি আর
কিছুই আমি বলতে পারবো না
স্নান
জয় গোস্বামী
সংকোচে জানাই
আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে।
এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল
না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি
অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে
জানি, পুরুষের
কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের
দেশে নিয়ে যাবে ব’লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে
পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো
এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।
আজ যদি বলি,
সেই
মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার
জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ,
দ্যাখো,
যার
জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই
রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?
শোনো, আমি
রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক’রে
রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ’রে
ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের
জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে
আমি জ্যোৎস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই
মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।
দ্যাখো, সেই
মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো
তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ
করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো,
তার
দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক,
এই
তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের
আগুনে স্তম্ভিত ক’রে রেখে
উন্মাদ কবির
সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।
———————————————